Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:35 pm

লক্কড়-ঝক্কড় বাস ৩৫ লাখ টাকা ধরে ভাড়া নির্ধারণ!

ইসমাইল আলী: ঢাকা শহরে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসই লক্কড়-ঝক্কড়। অথচ এসব বাসের মূল্য ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। ব্যাংকঋণে কেনা এসব বাসের সুদ পরিশোধ ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১০ লাখ টাকা। পাশাপাশি নিবন্ধন ফি ৪২ হাজার টাকা। এতে প্রতিটি বাসের পেছনে বিনিয়োগ ব্যয় পড়ছে প্রায় ৪৬ লাখ টাকা। এর ভিত্তিতে গত রোববার নির্ধারণ করা হয়েছে বাস ভাড়া।

শুধু বাসের দামই নয়, আরও অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ধরা হয়েছে ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে। যেমনÑবিমা খরচ, টোল খরচ, প্রতি মাসে টায়ার-টিউব পরিবর্তন, ছয় মাসে দুটি ব্যাটারি বদল, নিয়মিত বাসের রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতি পাঁচ বছরে বাস রেনোভেশন করা ইত্যাদি। এ ছাড়া রাস্তায় রাখা হলেও রয়েছে বাসের গ্যারেজ ভাড়া। আবার দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতিও দেখানো হয়েছে ভাড়ার নির্ধারণে।

এভাবেই ১৬টি খাতে ব্যয় যোগ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে দুই টাকা ১৫ পয়সা। আগে এ হার ছিল এক টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে বাস ভাড়া ৪৫ পয়সা তথা সাড়ে ২৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যদিও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণে বিবেচিত বেশিরভাগ উপাদানই অযৌক্তিক।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ব্যয় বিশ্লেষণ হিসাব বলছে, প্রতিটি বাসের গড় আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ১০ বছর। প্রতি বছর বাসগুলো চলবে ৩০০ দিন। আর আসনের ৯৫ শতাংশ যাত্রী বহন করবে বাসগুলো। যদিও আসনের চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করে বাসগুলো। কখনও কখনও দেড়গুণ পর্যন্ত যাত্রীও বহন করা হয়। তবে ৯৫ শতাংশ যাত্রী বহন দেখিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করায় কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বেশি পড়েছে।

এদিকে প্রতিটি বাসে গড়ে প্রতি মাসে টায়ার-টিউব পরিবর্তন করতে হবে দেখানো হয়েছে। এতে বছরে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও ইঞ্জিন ওভারহোলিং না করা হলেও বছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে চার লাখ ৬৮ হাজার টাকা। আর সাধারণত বিমা না করলেও এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কোনো ধরনের টোল না থাকলেও এ খাতে বছরে ২৫ হাজার ৬০০ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

রাজপথে চলা বাসগুলো রংচটা ও লক্কড়-ঝক্কড় হলেও পাঁচ বছরে এগুলো রেনোভেশন করা হবে বলা হয়েছে। এতে বছরে গড়ে ব্যয় পড়বে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। আবার দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে বছরে ৬৫ হাজার টাকা। আর রাস্তায় রাখা হলেও বাসের গ্যারেজ ভাড়া ৬৫ হাজার টাকা।

এদিকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলাচলকারী বেশিরভাগ বাসেই চালক ও একজন সহকারী থাকলেও ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে চালকের দু’জন সহকারী (একজন হেল্পার ও একজন কন্ডাক্টর)। তাদের দৈনিক দুই হাজার ১০০ টাকা হিসাবে বছরে বেতন ছয় লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর বোনাস বাবদ ব্যয় ৪০ হাজার টাকা। যদিও বেশিরভাগ বাসেই চালক ও সহকারীর কোনো বেতন-বোনাস নেই। বরং তাদের ট্রিপভিত্তিক চুক্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়।

প্রতিটি বাস দৈনিক ১২০ কিলোমিটার চলাচল করবে বলে ভাড়া নির্ধারণের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে। আর প্রতি লিটারে আড়াই কিলোমিটার হিসাবে দৈনিক ডিজেল খরচ দেখানো হয়েছে তিন হাজার ৮৪০ টাকা। এতে বছরে খরচ হবে ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এছাড়া বছরে দুটি ব্যাটারি বাবদ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় যুক্ত হয়েছে ভাড়ায়। এর সঙ্গে বছরে একটি ইঞ্জিন কুল্যান্ট কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭ হাজার টাকা।

১৬টি খাতে ব্যয় যোগ করে বছরে প্রতিটি বাস পরিচালনায় ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৪ লাখ টাকা। এ ব্যয়ের সঙ্গে বাস মালিকের ১০ শতাংশ মুনাফা যোগ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে প্রতি কিলোমিটার বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে দুই টাকা ১৫ পয়সা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন গন্তব্যের একটি বাসের প্রতি ট্রিপে কত যাত্রী হয়, বাসের বাজার মূল্য কত, বাসটি কত পথ পাড়ি দেয় এসব কখনোই সরেজমিন যাচাই করেনি বিআরটিএ। মালিকদের কথামতো ব্যয় বিশ্লেষণ হিসাবের সময় একটি অঙ্ক বসিয়ে দেয়া হয়।

এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাস ভাড়ার ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

যদিও বিআরটিএর চেয়ারম্যানের দাবি নাকচ করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাস ভাড়া নির্ধারণে ব্যয় বিশ্লেষণের মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাস ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়ছে। এক্ষেত্রে বাস পরিচালনায় যেসব খাতে খরচ হয়, সেগুলোয় যাত্রীদের নয়, মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়েছে। আর যানবাহনের ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে যে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি আছে, তার ১৪ সদস্যের সাতজনই মালিক সমিতির নেতা। বাকি সাতজনের ছয়জন সরকারি কর্মকর্তা এবং একজন থাকেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনের পক্ষ থেকে। ফলে বাস ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে মালিকদের ইচ্ছাই প্রাধান্য পায়। যাত্রীদের স্বার্থ সব সময়ই উপেক্ষিত হয়।

উল্লেখ্য, তড়িঘড়ি করে বাস ভাড়া বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও রুটভিত্তিক ভাড়ার তালিকা এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি বিআরটিএ। এতে ২৭ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও রুটভেদে ৫০-১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ভাড়া আদায় করছে বলে গতকাল বিভিন্ন পরিবহনে সরেজমিন দেখা গেছে।