Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 3:57 am

লক্ষ্মীপুরে নারকেলের ছোবড়ায় বছরে আয় অর্ধশত কোটি টাকা

জুনায়েদ আহম্মেদ, লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরে নারকেলের ফেলে দেয়া ছোবড়া দিয়ে বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা আয় হয়। একসময় শুধু জ্বালানি হিসেবে এ ছোবড়া ব্যবহার করা হতো। কিন্তু নারকেলের ছোবড়া এখন অনেক চাহিদাসম্পন্ন পণ্য। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর এলাকার  ছোবরা ব্যবসায়ী মো. এনাম উদ্দিন জানালেন, এখন শুধু ছোবড়াই নয়, ছোবড়ার গুঁড়াও অনেক দামি।

নারকেল ছোবড়া থেকে শৌখিন পণ্য তৈরির প্রধান উপাদান কোকোফাইবার এবং মাটিবিহীন ছাদবাগান, নার্সারির গাছ বপন, পশু ও পোলট্রি খামার তৈরির অন্যতম উপাদান কোকোডাস্ট। কোকোফাইবার ও কোকোডাস্ট উৎপাদনের প্রধান বাজার হিসেবে দেশের অন্যতম নারকেল উৎপাদনকারী জেলা লক্ষ্মীপুর।

লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত নারকেল থেকে কোকো ফাইবার ও ডাস্ট বিক্রি করে বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা আয় হয়। বর্তমানে নতুন এ দুটি পণ্যের চাহিদা এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কারখানাগুলো পণ্য উৎপাদন করার আগেই অগ্রিম বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, জেলায় দুই হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে নারিকেল বাগান রয়েছে। বাগান ও বাড়ি থেকে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি শুকনো নারিকেল আহরণ করা হয়। প্রসেসিং কারখানাগুলোতে শুকনো নারিকেলের ছোবড়া থেকে কোকোফাইবার বা আঁশ এবং ছোবড়ার গুঁড়া বা কোকোডাস্ট তৈরি করা হয়।

এদিকে ছোবড়া প্রসেসিং কারখানা গড়ে উঠেছে জেলার রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, সদর উপজেলার দালাল বাজার, জকসিন, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া, মীরগঞ্জ, সোনাপুর, কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট, রামগতির আলেকজান্ডার ও জমিদারহাটে। এসব এলাকায় ছোট বড় ৩০টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় নারী-পুরুষ মিলে কমপক্ষে ১০-১৫ শ্রমিক কাজ করেন।

জকসিন এলাকার ছোবরা কারখানা শ্রমিক রহিম জানান, আগে নারিকেলের ছোবড়ার আঁশ দিয়ে জাজিম, পাপোস, রশি, সোফা, চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হতো। বেডিং শিল্পেও ছোবড়ার ব্যবহার ছিল। আর ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুঁড়া পাওয়া যেত তা কোনো কাজে লাগত না। কিন্তু এখন কোকোফাইবার নামে ছোবড়ার আঁশ ও কোকোডাস্ট নামে ছোবড়ার গুঁড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজারের নারিকেল ব্যবসায়ী আবদুর রহিম জানান, প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন কয়েক টন ছোবড়াকে আঁশে পরিণত করা হয়। ব্যাপক চাহিদা থাকায় জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর ছোবড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছোবড়া থেকে মেশিনের সাহায্যে বের করা হয় আঁশ বা ফাইবার। ছোবড়া সংখ্যা হিসেবে ক্রয় করা হয়। এক হাজার নারকেলের ছোবড়ায় কমপক্ষে ৮০ কেজি আঁশ বা ফাইবার পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, প্রতিটি কারখানা থেকে বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ফাইবার বিক্রি করা হয়।

দালাল বাজার এলাকার ছোবড়া ব্যবসায়ী সততা ট্রেডার্সের মালিক জাকির হোসেন জানান, দুই বছর আগেও প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া কেনা হতো ৫০ পয়সা দরে। এখন মানভেদে প্রতিটি নারিকেলের ছোবড়া পাঁচ-সাত টাকায় কেনা হয়। ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির পর প্রতি ২০ কেজি ওজনের এক একটি ফাইবার বান্ডেল বিক্রি করে থাকেন পাঁচ-ছয়শ টাকা দরে।  প্রতিটি কারখানায় সপ্তাহে চার থেকে ছয় ট্রাক ফাইবার উৎপাদিত হয়। প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে ২০০ বান্ডেল ফাইবার বহন করা হয়। বিভিন্ন কোম্পানি ফাইবার নিয়ে তোশকের ভেতরের অংশ ম্যাট্রেস বা কয়ার ফেল্ট তৈরি হয়। সে কারণে বর্তমানে ছোবড়ার আঁশ বা ফাইবারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তিনি আরও জানান, সব খরচ বাদে এক একটি কারখানায় মাসে ৫০ হাজারের বেশি আয় হয়ে থাকে।

অন্যদিকে নার্সারি ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার হোসেন জানান, ছোবড়া থেকে ফাইবার তৈরির সময় যে গুঁড়া বের হয় তা দিয়ে শাকসবজি চাষ, আধুনিক গ্রিনহাউস ও ছাদবাগানের জন্য কোকোমাস ও কোকোডাস্ট তৈরি করা হয়। চারা উৎপাদনের জন্য এখন মাটির পরির্বতে কোকোডাস্ট খুবই জনপ্রিয়। এক হাজার নারকেলের উপজাত হিসেবে বের হয় ১৬০ কেজির মতো গুঁড়া বা কোকোডাস্ট। ২০ কেজির প্রতি বস্তা কোকোডাস্ট ১৪০ থেকে ১৬০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করা হয়।

লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরীর সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শাহরিয়ার ইসলাম খান বলেন, ফেলনা নারিকেল ছোবড়া থেকে লক্ষ্মীপুরে অনেকগুলো কারখানা তৈরি হয়ে বহু মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা আয় হচ্ছে কোকো ফাইবার ও কোকোডাস্ট থেকে। এসব কারখানার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণসহ আর্থিক সহায়তা দিলে এ শিল্প আলোর মুখ দেখবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।