জুনায়েদ আহমেদ, লক্ষ্মীপুর: দীর্ঘদিন দেশে সয়াবিন আমদানি বন্ধ থাকায় ও স্থানীয় উৎপাদিত সয়াবিনের অপ্রতুলতার কারণে লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন প্রক্রিয়াকরণ পাঁচটি বড় প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় দৈনিক প্রায় ৭০০ টন উৎপাদন কমে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কোনো কোনো কারখানা টানা প্রায় দুই মাস বন্ধ রয়েছে। অনেক শ্রমিক বেকারের পাশাপাশি বড় রকমের লোকসানে পড়েছে কারখানার মালিকরা। এতে প্রসেসিং বা ফুল ফ্যাট সয়াবিনের অভাবে পোলট্রি ফিড, ফিশ ফিড, ক্যাটেল ফিড ও সয়াবিনের ওপর নির্ভরশীল সব পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের ভোগ্যপণ্যের ওপর।
সরজমিন ঘুরে লক্ষ্মীপুরের সয়াবিন প্রসেসিং কারখানা মালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চর মনসা গ্রামে অবস্থিত হাজী নূর নবী সয়াবিন প্রসেসিং মিলস। যেখানে কাঁচা সয়াবিন মেশিনের সাহায্যে সিদ্ধ করে শুকিয়ে ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি করা হয়। প্রায় ছয় বছর আগে সয়াবিন ক্ষেতে প্রতিষ্ঠিত হয় এ কারখানা। দুটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তরুণ দুই ভাই নোমান ও সুমন বাবার নামে গড়ে তোলেন কারখানাটি।
কারখানার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মো. নোমান জানান, প্রথমে ভালোই চলছিল। হাজী প্রতিদিন ১০০ মেট্রিক টন ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি করা যেত। গত বছর কভিডে কিছুটা সমস্যা হয়। তবু দৈনিক ৮০ থেকে ৯০ টন ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি হতো। স্থানীয় ও আমদানি করা সয়াবিনের অভাবে গত দুই মাস তাদের কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫ জন শ্রমিক-কর্মচারীর প্রায় সবাই বেকার। কিন্তু মেশিন মেইনটেন্যান্স, ব্যাংক ঋণ ও বিদ্যুৎ বিলসহ নানা কারণে প্রতি মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. সুমন জানান, বছরের ছয় মাস স্থানীয় উৎপাদিত সয়াবিন ও বাকি ছয় মাস আমদানি করা সয়াবিন থেকে তাদের কারখানা চলে। কিন্ত কভিডের কারণে চলতি বছর এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী চলমান লকডাউনের কারণে সয়াবিন আমদানি বন্ধ রয়েছে। দুই মাস আগে স্থানীয় উৎপাদিত সয়াবিনেরও সংকট দেখা দেয়। এমতাবস্থায় সয়াবিনের অভাবে তাদের কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের পক্ষে কারখানা চালানো সম্ভব হবে না বলেও জানান সুমন।
লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত কোয়ালিটি সয়াবিন প্রসেসিং মিলসের মালিক মো. আবদুর রহিম জানান, তার কারখানায় দৈনিক ১১০ টন ফুল ফ্যাট সয়াবিন উৎপাদন হত। গত দুই মাস উৎপাদন প্রায় বন্ধ।
মাঝেমধ্যে মেশিন মেইনটেন্যান্সের জন্য ১০ থকে ২০ টন সয়াবিন প্রসেস করা হয়।
তিনি আরও জানান, স্থানীয় উৎপাদিত সয়াবিন প্রায় শেষ। এখন যেসব ব্যবসায়ীর কাছে সয়াবিন আছে তারা আরও লাভের আশায় স্থানীয় সয়াবিন বাজারে ছাড়ছেন না। অন্যদিকে এপ্রিল থেকে সয়াবিনের আমদানি বন্ধ থাকায় কাঁচামালের অভাবে কারখানা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি তার কারখানার ২০ জন শ্রমিক ছাঁটাই করেছেন।
সদর উপজেলার চর চামিতা এলাকায় রয়েছে নাসরিন এগ্রো কমপ্লেক্সে। জেলার বৃহত্তম দুটি সয়াবিন প্রসেসিং কারখানা রয়েছে এ কমপ্লেক্সে। এ দুটি কারখানায় দৈনিক পাঁচ শতাধিক টন প্রসেস বা ফুল ফ্যাট সয়াবিন উৎপাদিত হয়।
কারখানার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাসনাইন আবদুল্লাহ নাসির জানান, এ বছর প্রায় ৩০ হাজার টন স্থানীয় উৎপাদিত সয়াবিন ক্রয় করে নাসরিন এগ্রো কমপ্লেক্স। স্থানীয় সয়াবিনে তাদের দুই মাস কারখানা চলে। এরপর তারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন আমদানি করে। বর্তমানে আমদানি করা সয়াবিনে তাদের কারখানা চলছে। তবে উৎপাদন ৫০০ টনের মধ্যে দৈনিক ২০০ টন।
তিনি আরও জানান, আমদানি করার কারণে কারখানা কোনোমতে চলছে, তবে স্থানীয় সয়াবিনে নির্ভর কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প নগরীর চৌধুরী অটোর স্বত্বাধিকারী মো. রিয়াজ জানান, সয়াবিন প্রসেসিং মিলসে কাঁচা সয়াবিনকে মেশিনের সাহায়্যে সেদ্ধ করে শুকানো হয়। শুকানো সয়াবিনকে বলা হয় ফুল ফ্যাট সয়াবিন, যা অনেক বছর সংরক্ষণ করা যায়। ফুল ফ্যাট সয়াবিন গুঁড়ো করে সয়াবিন মিল (খৈল) তৈরি করা হয়। সয়াবিন মিল থেকে তৈল, পোলট্রি, মাছ, পশু খাদ্য ও সয়াবিনজাত পণ্য তৈরি করা হয়।
লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প নগরীর অফিস সূত্রে জানা গেছে, দেশের এক নম্বর সয়াবিন উৎপাদনের জেলায় ৭টি সয়াবিন কারখানার মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি সয়াবিন প্রসেসিং কারখানা চালু রয়েছে। যেগুলোয় দৈনিক প্রায় এক হাজার টন প্রসেসিং করা হয়। এর মধ্যে বিসিক শিল্পনগরীর দুটি কারখানায় ৪০০ টন, ভবানীগঞ্জের চরমনসাতে অবস্থিত একটি কারখানায় ১০০ টন এবং চর চামিতায় অবস্থিত দুটি কারখানায় ৫০০ টন। অন্যদিকে সদর উপজেলার মজুচৌধুরীরহাট এবং তেরবেকি এলাকায় অবস্থিত দুটি সয়াবিন প্রসেসিং কারখানা
বন্ধ রয়েছে। সব কারখানায় এক হাজার টনের পরিবর্তে বর্তমানে ৩০০ টন উৎপাদন হচ্ছে।
সয়াবিন ট্রেডিং ব্যবসায়ী মো. ইসমাঈল জানান, কাঁচা সয়াবিন, ফুল ফ্যাট সয়াবিনসহ সয়াবিনের কাঁচামালের পুরো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ঢাকার মতিঝিলের ট্রেডিং এজেন্সিগুলোর হাতে। ট্রেডিং এজেন্সিগুলো সয়াবিন মৌসুমে স্থানীয় আড়তদারদের মাধ্যমে কাঁচা সয়াবিন কিনে সংরক্ষণ করে। পরে ওই সয়াবিন পাঠায় প্রসেসিং মিলসে। প্রসেসিং মিলসগুলো প্রতি টন ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে সিদ্ধ করে শুকিয়ে ফুল ফ্যাট সয়াবিন তৈরি করে আবার এজেন্সিতে পাঠায়। ট্রেডিং এজেন্সি থেকে ফিড কোম্পানিগুলো ফুল ফ্যাট সয়াবিন কিনে পোলট্রি ফিড, ফিশ ফিড, ক্যাটেল ফিড এবং সয়াবিনজাত পণ্য তৈরি করে। কোনো ট্রেডিং এজেন্সি ফুল ফ্যাট সয়াবিন রপ্তানিও করে।
লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি অফিসের তথ্য কর্মকর্তা আবুল হোসেন জানিয়েছেন, গত মৌসুমে লক্ষ্মীপুরে ৯০ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়। এ সময় সারাদেশে উৎপাদিত হয় এক লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন।
সয়াবিন থেকে তেল, পোলট্রি ফিড, ফিশ ফিড, ক্যাটেল ফিড, রকমারি খাবার ও সাবান তৈরি করা হয়। সয়াবিনে অপ্রতুলতার কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, যা সরাসরি ক্রেতাদের ওপর চাপ পড়ছে।