বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পিত উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান চূড়ান্ত করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে আগের মাস্টারপ্ল্যানের ব্যর্থতা ও ২৫ বছর মেয়াদি নতুন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনের প্রথম পর্ব
ইসমাইল আলী: ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১১ হাজার ৪০৫ মেগাওয়াট। পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান-২০১০-এ এমনটাই ধরা হয়েছিল। তবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, গত বছর গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট। এর আগের কয়েক বছরই একই গতিবিধি দেখা গেছে। আর ২০২০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১২ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট। যদিও মহাপরিকল্পনায় ধরা হয় ১৭ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট।
গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের চাহিদা লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়েনি। এর মূল কারণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা। এতে একদিকে শিল্পের উন্নয়ন হয়নি, অন্যদিকে জীবনযাত্রার মানও তুলনামূলক কম উন্নয়ন হয়েছে। আবার বিদ্যুতের সরবরাহও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়েনি। বিদ্যুৎ খাতের নতুন মাস্টারপ্ল্যানে এমন মন্তব্যই করা হয়েছে।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে মাস্টারপ্ল্যানটি প্রণয়ন করছে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্ভিস কোম্পানি। গত মাসে এ-সংক্রান্ত চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জাইকা।
যদিও এর সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, শিল্প ক্ষেত্রে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। আবার আবাসিকেও বিদ্যুতের সংকট রয়েছে। গ্রীষ্মকালে এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করে।
তথ্যমতে, বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পিত উন্নয়নে ২০১০ সালে প্রণয়ন করা হয় পাওয়ার সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান। ২০ বছর মেয়াদি ওই মহাপরিকল্পনায় সাত শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছিল। তবে ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে পরপর চার বছর সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়নি। বরং তা ছয় থেকে সাড়ে ছয় শতাংশে ওঠানামা করে। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুতের চাহিদায়।
এতে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা ছিল ছয় হাজার ৪৫৪ মেগাওয়াট। যদিও সে অর্থবছর বাস্তব চাহিদা ছিল চার হাজার ৬০৬ মেগাওয়াট। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ৮৯০ মেগাওয়াট। অথচ ওই অর্থবছর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা ছিল ছয় হাজার ৭৬৫ মেগাওয়াট। এছাড়া ২০১১-১২ অর্থবছরে সম্ভাব্য ও প্রকৃত চাহিদা ছিল যথাক্রমে সাত হাজার ৫১৮ ও ছয় হাজার ৬৬ মেগাওয়াট। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে আট হাজার ৩৪৯ ও ছয় হাজার ৪৩৪ মেগাওয়াট।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা ছিল ৯ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। যদিও সে সময় প্রকৃত চাহিদা ছিল সাত হাজার ৩৫৬ মেগাওয়াট। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ৮১৭ মেগাওয়াট। কিন্তু সে সময় লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১০ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াট। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা ছিল ১১ হাজার ৪০৫ মেগাওয়াট। যদিও বাস্তব চাহিদা দাঁড়ায় আট হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ শেয়ার বিজকে বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ না বাড়া। এজন্য শিল্প খাতে নতুন করে ক্যাপটিভ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আবাসিকে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য দেশব্যাপী জরিপ চালানো হয়েছে। এতে আগামীতে পরিকল্পিতভাবেই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হয় নতুন মহাপরিকল্পনায়। এতে বলা হয়, শিল্প খাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশের রফতানি খাত মূলত পোশাক শিল্পনির্ভর। এ শিল্পে বিদ্যুতের ব্যবহার তুলনামূলক কম। হালকা প্রকৌশল ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কিছুটা বিকশিত হলেও রফতানিতে তেমন অবদান রাখতে পারছে না। আর ভারি শিল্পের বিকাশও খুব একটা হয়নি। তাই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী শিল্প খাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে না। এছাড়া জিডিপির অনুপাতে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার কম।
শিল্প খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার না বাড়ার জন্য সরকারের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, এক সময় শিল্পে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রেখে ক্যাপটিভে উৎসাহ দেওয়া হলো। সরকারের ভুল নীতির কারণে ক্যাপটিভ পাওয়ারের দিকে ঝুঁকেছেন শিল্প মালিকরা। ফলে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্প খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার বাড়েনি। আর সরকার সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কারণে সাধারণ গ্রাহকদের বেশি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। সব মিলিয়ে চাহিদা আশানুরূপ বাড়েনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার গত কয়েক বছরে বেড়েছে। তবে আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুতের ব্যবহার আশানুরূপ বাড়েনি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের ব্যবহার তুলনামূলক কম। এক্ষেত্রে সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতাও রয়েছে। এছাড়া শহরে বৈদ্যুতিক পাখার পরিবর্তে বাসাবাড়িতে এসির ব্যবহার অনেক কম। এতে শহরেও মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমই বেড়েছে।
এদিকে বিদ্যুতের চাহিদার পাশাপাশি সরবরাহও খুব বেশি হারে বাড়েনি। ২০১৫ সালে জাতীয় গ্রিডে ১০ হাজার ৪৮৬ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে গ্যাস থেকে পাঁচ হাজার ৮৯৩, তেল থেকে দুই হাজার ৭৪৩ ও কয়লা দিয়ে এক হাজার ৮৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল। যদিও বাস্তবে যুক্ত হয়েছে চার হাজার ১৪৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে দুই হাজার ৫৪৬ মেগাওয়াট গ্যাস ও এক হাজার ৫৯৮ মেগাওয়াট তেল দিয়ে উৎপাদন করা হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, আগামী কয়েক বছরে শহরে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার সম্ভাবনা কম। কারণ টিভি, ফ্রিজ শহর জীবনে বহু আগের থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। আর মানুষের জীবনযাত্রার মান ততোটা উন্নত হয়নি যে ঘরে ঘরে এসির ব্যবহার হবে। গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটার একটা সীমা রয়েছে। ফলে শিল্পে ব্যবহার দ্রুত না বাড়লে বিদ্যুতের সার্বিক চাহিদা বাড়ার সুযোগ
Add Comment