পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ জনপ্রিয় দেশি ফল লটকন। আজকের আয়োজন এ ফলটির নানা দিক নিয়ে লটকনের চাষাবাদ
আদিমকালে লটকন জঙ্গলে পাওয়া যেত। বলতে গেলে ফলের তালিকায় লটকনের নাম ছিলই না। কিন্তু বর্তমানে জনপ্রিয় ফল হিসেবেই এটি স্থান করে নিয়েছে। দেশের প্রায় সব জায়গায় এর চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই এখন জঙ্গল ছেড়ে বাড়িতে কিংবা জমিতে এর চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। লটকন বাংলাদেশের সবখানে চাষ করা যায়। তাহলে চলুন এর চাষ পদ্ধতি জেনে নিই।
চাষ পদ্ধতি
লটকন উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের আর্দ্র আবহাওয়ায় ভালো জন্মে। বৃষ্টি বেশি হয় কিন্তু পানি জমে থাকে না এমন জায়গা লটকন চাষের জন্য যথাযথ। সুনিষ্কাশিত প্রায় সব ধরনের মাটিতেই এটির চাষ করা যায়। তবে বেলে দোআঁশ বা কাদা দোআঁশ, ক্ষারবিহীন, সামান্য অম্লযুক্ত মাটি লটকন গাছের জন্য উপযুক্ত। লটকন গাছ স্যাঁতসেঁতে ও আংশিক ছায়াময় পরিবেশে ভালো জন্মে। কিন্তু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ গাছ ভালো হয় আম বা কাঁঠালের মতো বড় গাছের নিচে রোপণ করলে। মধুপুর অঞ্চলের জমি এ ফলের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত।
যে জায়গায় চারা রোপণ করা হবে, সে জায়গাটি চাষ ও মই দিয়ে সমতল করে নিতে হবে। আগাছা দমন করে নিতে হবে। চারা রোপণের উত্তম সময় বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ অর্থাৎ এপ্রিল থেকে মে। তবে বর্ষার শেষদিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিনেও গাছ রোপণ করা যেতে পারে। রোপণ করার আগে এক মিটার চওড়া ও এক মিটার গভীর গর্ত করে নিতে হবে। গর্তের সারি থেকে সারির দূরত্ব ছয় মিটার হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতি গর্তে জৈবসার অথবা গোবর, টিএসপি ও এমপি সার গর্তের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে রাখতে হবে। গর্ত ভরাট করার ১০ থেকে ১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা গর্তের মাঝখানে লাগাতে হবে। চারা রোপণের আগে বৃষ্টি না হলে গর্তের মাটিতে কিছু পানি দিয়ে হালকা করে ভিজিয়ে রাখতে হবে। রোপণের জন্য বিকালই প্রকৃষ্ট সময়। রোপণের সময় চারার মূলগুলোকে ভালোভাবে গর্তের ভেতরে ঢুকিয়ে মাটিচাপা দিতে হবে। ওপরে থাকলে শিকড় শুকিয়ে মারাও যেতে পারে। চারা লাগানোর পরপরই পানি দিতে হবে।
বীজ থেকে চারা উৎপাদন করেও বংশ বিস্তার করা যায়। তবে এতে ফলের মাতৃগুণ বজায় থাকে না। এজন্য গুটিকলমের চারা ব্যবহার করা ভালো। লটকনের বীজের আবরণ অত্যন্ত শক্ত। তাই বীজ জমিতে বা পলিব্যাগে বোনার আগে এক থেকে দুদিন পানিতে ভিজিয়ে নিলে চারা দ্রুত গজায়। প্রাথমিক অবস্থায় গাছের বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি হয়। এরপর এক বছর বয়সের চারা মূল জমিতে লাগানো যায়। গুটিকলমের জন্য নির্বাচিত গাছের সুস্থ, সবল, সতেজ ও নিরোগ ডালের মধ্যে গ্রীষ্মের প্রথম ভাগে গুটিকলম করতে হয়। চিকন ও সমান্তরাল ডাল এ কাজের জন্য ব্যবহার করা উত্তম। এতে বর্ষার আগে শিকড় বের হবে। ডাল কেটে গুটিকলম মূল জমিতে বর্ষাকালে লাগানো যাবে। বীজের গাছে ফল আসতে পাঁচ-ছয় বছর সময় লাগে কিন্তু কলমের গাছে দু-তিন বছর পর ফল ধরা শুরু করে।
রোগবালাই ও প্রতিকার…
লটকনে রোগবালাই ও পোকামাকড় দেখা দিলে ফলের মান খারাপ হয়। এতে যেমন খাদ্যের চাহিদা কমে, তেমনি বাজারে দামও কমে যায়। তাই এর মান ভালো রাখতে এবং চাহিদা বাড়াতে রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন করতে হবে। লটকন গাছে ও ফলে যেসব রোগ ও পোকা আক্রমণ করে থাকে, সে সম্পর্কে জেনে রাখতে পারেন:
রোগবালাই
অ্যানথ্রাকনোজ
কলেটোট্রিকাম সিডি নামক এক ধরনের ছত্রাক লটকনের অ্যানথ্রাকনোজ রোগের কারণ। গাছের পাতা, কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা ও ফল এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগ দেখা দিলে ফলের গায়ে ছোট কালো দাগ হয়। তাছাড়া ফল শক্ত, ছোট ও বিকৃত আকারের হওয়ার শঙ্কা থাকে। ফল পাকা শুরু হলে দাগ দ্রুত বিস্তৃত হতে থাকে ও ফল ফেটে বা পচে যায়।
ঢলে পড়া
ফিউজেরিয়াম নামক ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়। প্রথমে পাতা হলুদ হয়ে আসে ও পরে শুকিয়ে যায়। এভাবে পাতার পর প্রশাখা-শাখা এবং ধীরে ধীরে সব গাছই নেতিয়ে পড়ে ও মারা যায়।
ফল ঝরে যাওয়া
পরাগায়ণের অভাব, অধিক খরা বা শীত মৌসুমে ও ফুল ধরার সময় মাটিতে সেচ না দেওয়া, মাটিতে বোরনের অভাব, রোগ বা পোকার আক্রমণ প্রভৃতি অনেক কারণে ফল ঝরে যায়।
দমন ব্যবস্থা
আক্রান্ত গাছের পাতা ও ফল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে ফল ধরার পর ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ভালোভাবে স্প্রে করে এসব রোগ দমন করতে হবে। এছাড়া শীত বা খরা মৌসুমে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। গাছে ফুল ফোটার পরও সেচ দিতে হবে।
পোকামাকড় ফল ছিদ্রকারী পোকা
ছোট অবস্থায় যখন খোসা নরম থাকে, তখন এ পোকা ফলের খোসা ছিদ্র করে ডিম পাড়তে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ডিম থেকে কীড়া উৎপন্ন হয় ও এটি ফলের নরম শাঁস খেয়ে ফল নষ্ট করে ফেলে।
মিলিবাগ ও সাদা মাছিপোকা
এদের আক্রমণে পাতায় সাদা তুলার মতো দাগ হতে দেখা যায়। এরা পাতার রস শুষে গাছকে দুর্বল করে দেয়। রস শোষণের সময় পাতায় বিষ্ঠা ত্যাগ করে। সেই বিষ্ঠার ওপর শুটিমোল্ড নামক ছত্রাক জšে§ পাতার খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে।
চেফার বিটল
এ পোকা পূর্ণাঙ্গ পাতা খেয়ে ছিদ্র করে ফেলে। ধীরে ধীরে গোটা পাতা খেয়ে জালের মতো করে ফেলে।
স্কেল পোকা
এ পোকা পাতা বা কাণ্ডে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়ে পাতা ও কচি ডাল থেকে রস শোষণ করে খেতে থাকে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সম্পূর্ণ গাছের।
দমন ব্যবস্থা
আক্রান্ত ফল পোকাসহ মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে কীটনাশক মিশিয়ে ১৫ দিন অন্তর ফলের গায়ে স্প্রে করতে হবে। সাদা মাছি পোকা দমনের ক্ষেত্রে আক্রান্ত পাতা ও ডগা পোকাসহ কেটে ধ্বংস করতে হবে। স্কেল পোকার ক্ষেত্রে আক্রমণ দেখামাত্রই কাণ্ডে ব্রাশ দিয়ে ঘষে পোকা মেরে ফেলতে হবে। সাবান-পানি স্প্রে করলেও প্রাথমিকভাবে দমন করা সম্ভব।
পরিচর্যা ও ফল সংগ্রহ
লটকনের চারা রোপণের পর এর সঠিক পরিচর্যা প্রয়োজন। এতে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়।
পরিচর্যা
লটকনের চারা রোপণের আগে গর্ত করে ১০ থেকে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে। এরপর গর্তের মাঝখানে নির্বাচিত চারা সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর পানি দিতে হবে। এক থেকে দুদিন অন্তর পানি দিতে হবে। তাই আগে থেকে সেচের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। কেননা, চারা রোপণের প্রথম দিকে ঘন ঘন সেচ দেওয়া দরকার। ফুল আসার পর ও ফল ধরার পর দু-একটি সেচ দিতে পারলে উপকার পাওয়া যায়।
চারার প্রাথমিক অবস্থায় খুঁটি লাগানো আবশ্যক। প্রয়োজনবোধে বেড়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। গাছ একটু বড় হয়ে গেলে অতিরিক্ত শাখা না রাখাই ভালো। গাছের মরা ডাল থাকলে বা রোগবালাই আক্রান্ত হলে সেই ডাল কেটে ফেলে দিতে হবে। গাছে যখন ফল আসবে, তখন সতর্ক থাকতে হবে যাতে রোদ ফলের গায়ে না লাগে। এক্ষেত্রে রোগের অংশটুকু চটের বস্তা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফলের গায়ে ঢেকে দিতে হবে। এ ফল রোদ বেশি সহ্য করতে পারে না, তাই গাছ সব সময় ছায়াযুক্ত স্থানে রোপণ করতে হবে।
সার দেওয়া
গাছে শুধু পানি দিলেই চলবে না, সারও দিতে হবে। প্রতি বছর পূর্ণবয়স্ক গাছে নিয়মানুসারে সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর বা জৈবসার, ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি প্রভৃতি দিতে হবে। এসব সার গাছের গোড়া থেকে এক মিটার দূরে ছিটিয়ে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে দুপুুরের পর ছায়া পড়ে, সে সময় সার দেওয়া উত্তম।
ফল সংগ্রহ
সাধারণত জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ফল পাকে। এ সময় ফলের থোকাগুলো গাছ থেকে ছিঁড়ে বাঁশের ঝুড়িতে খড় বা ছালার চটের ওপর রাখতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ফলের গায়ে কোনো ধরনের আঘাত না লাগে। পরে ফলে হলুদ বর্ণ ধারণ করার জন্য ঘরের গরম স্থানে চট দিয়ে ঢেকে রেখে দিতে হবে। তাহলেই ফল তাড়াতাড়ি পাকবে। ফল পাকার পর দ্রুত বাজারজাত করতে হবে; কারণ পাকা ফল তিন-চার দিনের বেশি সংরক্ষণ করা হলে ফলের খোসার ওপরে খয়েরি দাগ পড়ে ও এর মিষ্টি স্বাদ নষ্ট হয়ে টক স্বাদ চলে আসে। এতে বাজারমূল্যও কমে যায়।
পুষ্টিগুণে ভরা
টক-মিষ্টি স্বাদের ফল লটকন। হলুদাভ ছোট ও গোলাকার এ ফলটি পুষ্টি ও ঔষধি গুণে পরিপূর্ণ। তাই তো ছোট-বড় সবারই পছন্দের এই ফল। এতে ভিটামিন ও খাদ্যশক্তিসহ নানারকম খনিজ উপাদান রয়েছে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
# লটকনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘বি’। এতে ভিটামিন বি-১ ও ভিটামিন বি-২ আছে যথাক্রমে ১০ দশমিক ০৪ মিলিগ্রাম ও ০ দশমিক ২০ মিলিগ্রাম। ফলে পাকা লটকন খাদ্যমানের দিক দিয়ে খুবই সমৃদ্ধ
# লটকনে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এ ফলের মৌসুমে প্রতিদিন দু-তিনটি করে খেলে দৈনন্দিন ভিটামিন ‘সি’র চাহিদা পূরণ হবে। ভিটামিন ‘সি’ ত্বক, দাঁত ও হাড় সুস্থ রাখে। লটকনে যে আয়রন রয়েছে তা রক্ত ও হাড়ের জন্য বিশেষ উপকারী
# খাদ্যশক্তির ভালো উৎস লটকন। শরীর সক্রিয় রাখতে ও দৈনন্দিন কাজ করতে খাদ্যশক্তি প্রয়োজন। লটকনে খাদ্যশক্তি প্রায় দ্বিগুণ রয়েছে। এছাড়া এ ফলে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে চর্বি, আমিষ, লৌহ ও খনিজ পদার্থ
# লটকন খেলে বমি বমি ভাব দূর হয় সহজেই। এটি তৃষ্ণাও নিবারণ করে। মানসিক চাপ কমায় এ ফল। এর গাছের ছাল ও পাতা খেলে চর্মরোগ দূর হয়
# লটকন গাছের শুকনো গুঁড়ো পাতায় ডায়রিয়া বেশ দ্রুত উপশম হয়। এর গাছের পাতা ও মূল খেলে পেটের বিভিন্ন অসুখ ও পুরোনো জ্বর নিরাময় হয়। এমনকি গনোরিয়া রোগের ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয় এ ফলের বীজ
# লটকনে রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড ও এনজাইম, যা দেহগঠন ও কোষকলার সুস্থতায় কাজে লাগে। এসব উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে
# লটকন খেলে আর্থ্রাইটিস রোগে উপকার পাওয়া যায়
# পাকস্থলীর ব্যথা ও আলসার সারাতে লটকন বেশ উপকারী
# লটকন ফল খেলে ব্রণ ও ত্বকের দাগ কমে আসে
# এ ফল মুখের রুচি বাড়ায়।