লাইটার জাহাজ মালিকদের মধ্যে বিভক্তি

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: মাদার ভেসেলে করে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য ছোট জাহাজ বা লাইটার ভেসেলে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবহন করা হয়। এ ধরনের জাহাজের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন রুটে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করত ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)। কিন্তু ডব্লিউটিসির কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করে চট্টগ্রামের লাইটার জাহাজ মালিকরা মিলে ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগং নামে নতুন সেল গঠন করেছেন। এই সেলের মাধ্যমে জাহাজ বরাদ্দ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করা হবে।

জানা যায়, প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট, সার, তেলসহ আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে প্রায় এক হাজার জাহাজ আসে। এসব জাহাজের পণ্য ছোট জাহাজ বা লাইটার ভেসেলে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আমদানিকারকের নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য পরিবাহিত হয়। এ ধরনের জাহাজের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।  ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতটি গুরুত্বপূর্ণ। জোয়ার-ভাটানির্ভর চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরনের জাহাজ ভিড়তে পারে না। সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টন পণ্য নিয়ে আসা মাঝারি আকৃতির জাহাজ বন্দরের জেটিতে নোঙর করতে পারে। এই ধরনের জাহাজে পণ্য পরিবহনের খরচ তুলনামূলক বেশি। তাই আমদানিকারকরা ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে সক্ষম বড় মাদার ভেসেলে পণ্য এনে থাকেন। এসব জাহাজে একই সঙ্গে অনেক বেশি পণ্য আনার সুযোগ থাকায় খরচ কম পড়ে। কিন্তু এ ধরনের বড় জাহাজগুলো বন্দরে ভিড়তে পারে না। ফলে বহির্নোঙরে অবস্থান নিয়ে পণ্য খালাস করতে হয়। বহির্নোঙরে পণ্য খালাসের পুরো কার্যক্রম পরিচালিত হয় লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে। এছাড়া বন্দরের অভ্যন্তরে জাহাজের ওভারসাইড (নদীর সাইড) থেকেও লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বর্তমানে বছরে গড়ে প্রায় এক হাজার জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়। এসব জাহাজে গড়ে অন্তত দশ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং হয়ে থাকে। এসব পণ্যের মধ্যে গম, চিনি, সার, সিমেন্ট ক্লিংকারসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানার কাঁচামাল রয়েছে। এগুলো চট্টগ্রাম বন্দর ও বহির্নোঙর থেকে বন্দর চ্যানেলের নানা ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। এছাড়া চট্টগ্রামের সিইউএফএল ও কাফকোর উৎপাদিত সারের একটি অংশও বিসিআইসির নিয়ন্ত্রিত ২৫টি জেলার বাফার গুদামে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। ফলে এসব জাহাজের স্বাভাবিক চলাচলের ওপর দেশের পণ্য পরিবহন নেটওয়ার্ক পুরোপুরি নির্ভরশীল। যদিও বিভিন্ন সিমেন্ট কারখানাসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের মালিকানাধীন লাইটারেজ জাহাজে পণ্য পরিবহন করলেও সাধারণ আমদানিকারকদের পণ্য পরিবহন ডব্লিউটিসির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ডব্লিউটিসি প্রতিদিন বার্থিং সভা করে আমদানিকারকদের চাহিদার বিপরীতে লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়।

ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কর্মকর্র্তারা বলেন, ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলে ৩৩ জন পণ্যের এজেন্ট এবং ৬০ জন লোকাল এজেন্ট রয়েছেন। ডব্লিউটিসি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করে জাহাজ বরাদ্দ এবং ভাড়া আদায় করে থাকে। এর মধ্যে আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে পণ্যের এজেন্টরা ডব্লিউটিসির তালিকাভুক্ত লোকাল এজেন্টদের কাছ থেকে জাহাজ ভাড়া নেন এবং ভাড়ার টাকা ডব্লিউটিসিকে দেন। ডব্লিউটিসি আদায়কৃত ভাড়া লোকাল এজেন্টকে দেয়। পরে লোকাল এজেন্ট ভাড়া দেয় জাহাজ মালিকদের।

কয়েকজন আমদানিকারক বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ খাতের পণ্য পরিবহনের পুরোটাই ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কার্যক্রম থেকে শুরু করে দেশের আমদানি বাণিজ্য অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন খাতের এই কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল। ফলে লাইটারেজ জাহাজ চলাচলে কোনো ধরনের সংকট দেখা দিলে পুরো ব্যবস্থাপনায় ধস নামে।

তাই ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগং নামে নতুন সেলের উদ্যোক্তারা বলেন, লাইটার জাহাজ পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনার জন্য ২০০৫ সালে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল গঠিত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন রুটে পণ্য পরিবাহিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকদের বিভিন্ন সময়ের বিরোধ, জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং অলস জাহাজের সারি দীর্ঘ হলেও পছন্দের জাহাজে একাধিক ট্রিপ দেয়া প্রভৃতি নিয়ে ডব্লিউটিসির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। ফলে ডব্লিউটিসি ভেঙে চট্টগ্রামে একই আদলের নতুন একটি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার নগরীর হোটেল আগ্রাবাদে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়।

ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং নামে শুরু হওয়া এই সংগঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরউদ্দিন। তিনি নতুন সেলের কনভেনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এ বিষয়ে জানার জন্য নতুন সংগঠনের সভাপতি হাজি শফিক আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আজিজুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিবার যোগাযোগ করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনের একজন উদ্যোক্তা বলেন, শুরুতে আমরা চারশ’র মতো জাহাজ নিয়ে আমাদের কার্যক্রম শুরু করব। ক্রমান্বয়ে আরও অনেক জাহাজ মালিককে যুক্ত করব। মূলত দেশের আমদানিকারক এবং জাহাজ মালিকরা ডব্লিউটিসির কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন। তাই এই নতুন সংগঠন।

অন্যদিকে ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমি অসুস্থ। এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে বিষয়টিকে তিনি ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০