Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 4:16 am

লাগামহীন খেলাপি ঋণ আদায়ের অবস্থা নাজুক

রোহান রাজিব: দেশের ব্যাংক খাতে আগ্রাসীভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। তবে বিপরীত চিত্র খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে। যেভাবে খেলাপি বাড়ছে, সেভাবে বাড়ছে না আদায়ের পরিমাণ। গত বছরের প্রথম ৯ মাস (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৮ শতাংশ। এ সময় খেলাপি ঋণ থেকে আদায় হয়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, টাকা ফেরত না দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাংক থেকে বড় ঋণ নেয়া হয়। এসব ঋণ বের করতে সহযোগিতা করে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা। তারা জানেন, এসব ঋণের ৯০ শতাংশ ফেরত আসবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ঋণ খেলাপি হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণের অঙ্ক বাড়ছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় নীতির জন্যও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যাংকাররা বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর উদাসীনতা রয়েছে। অপরদিকে অনিয়ম-দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ আদায় হচ্ছে না। এর জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে নাজুক অবস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি ১১ লাখ টাকায়, গত ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে ৯ মাসে আদায় না হওয়া মন্দ ও পুনঃতফসিল করা ঋণসহ খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৯ হাজার ৩২৬ কোটি ২০ লাখ টাকা বা ৩৮ দশমিক শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। একই সময় নগদ আদায় হয়েছে মাত্র সাত হাজার ৩৫৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, যা মোট খেলাপির ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাংকের কিছু ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়। এসব ঋণ মামলায় আটকে রয়েছে। আবার পুনঃতফসিল সুবিধাও নিচ্ছে। এসব সুবিধা নিচ্ছে বড় ঋণগ্রহীতারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত সুবিধা বন্ধ করে দেয়া এবং ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে তাগিদ দেয়া।

তিনি আরও বলেন, কিছু ঋণগ্রহীতা রয়েছেন, যারা আসলেই ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের ঋণগুলো ফেরত দেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ গ্রাহক ছোট হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যারা ফেরত দেয়ার অবস্থায় রয়েছেন, তারাই ফেরত দিচ্ছেন না।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ১৩৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর সঙ্গে আদায় না হওয়া মন্দ ও পুনঃতফসিল করা ঋণ যুক্ত হওয়ায় নতুন খেলাপি ঋণ হয়েছে ১৩ হাজার ৭৯২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র এক হাজার ৮৭৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। তবে গত বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) সময়ের চেয়ে এ আদায় অনেক কম। ওই সময় নগদ আদায় হয়েছে তিন হাজার ৮৫৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে আদায় কমেছে এক হাজার ৯৮১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। প্রথম প্রান্তিকে আদায়ের অঙ্ক ছিল এক হাজার ৬২২ কোটি ৬২ লাখ টাকা।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সম্মিলিতভাবে গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) নতুন করে সাত হাজার ৫২৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা খেলাপি হয়েছে। এ সময় খেলাপি থেকে নগদ আদায় হয়েছে ৪৬৯ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট খেলাপি ছিল ৬০ হাজার ৫০১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।

তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে ছয় হাজার ৪৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তাদের  আদায়ের অঙ্ক ছিল এক হাজার ২০৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এসব ব্যাংকে সেপ্টেম্বর শেষে মোট ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা খেলাপি দাঁড়ায়।

অপরদিকে বিদেশি ব্যাংকের নতুন করে খেলাপি হয়েছে ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এসব ব্যাংক আদায় করেছে ৩৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে তাদের মোট খেলাপি ঋণ দুই হাজার ৯৭০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা দাঁড়ায়। এ সময় বিশেষায়িত ব্যাংক খেলাপি থেকে আদায় করে ১৬৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপির অঙ্ক দাঁড়ায় চার হাজার ২৭৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় আদায় কম হওয়ার কারণ হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে শিথিল নীতি। ফলে দেখা যাচ্ছে, খেলাপি বাড়ছে, আদায় কম হচ্ছে। যেসব ব্যবসায়ী প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য সার্কুলার ঠিক আছে। অপরদিকে কিছু ব্যবসায়ী এটার সুযোগ নিয়ে টাকা পরিশোধ করছেন না। এতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা আসছে না এবং ব্যাংক নতুন করে লোন তৈরি করেত পারছে না ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব শিথিলতা দিয়েছে, তা কমিয়ে আনা উচিত। ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে কঠোর বার্তা দেয়া উচিত। এছাড়া বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য উপায়ে আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। আর ব্যবসায়ীদের উচিত নিজ ইচ্ছায় টাকা পরিশোধ করার মনোভাব তৈরি করা।

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর কেউ ঋণ পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সালে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ ঋণ শোধের কথা, সেক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে তা নিয়মিত রাখা হয়। গত ১৮ জুলাই এক নির্দেশনার মাধ্যমে একটি খেলাপি ঋণ চার দফায় ২৯ বছর পর্যন্ত পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয়া হয়। সব পর্যায়ে ডাউনপেমেন্টের হার কয়েকগুণ কমানো হয়েছে। আবার পুনঃতফসিলের পর নতুন ঋণ নিতে আগে যেখানে ১৫ শতাংশ কম্প্রোমাইজ অ্যামাউন্ট দেয়া লাগত, এখন তা তিন শতাংশে নামানো হয়েছে।