লালফিতায় বন্দি ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’

জি.এম জয়, রংপুর : পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নতি হওয়ার পরও পরিকল্পিত নগরায়ণে রংপুর মহানগরীকে ঘিরে তৈরি হয়নি কোনো মাস্টারপ্ল্যান। বছরের পর বছর চিঠি চালাচালি হলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় দীর্ঘদিনেও আলোর মুখ দেখেনি ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’। অথচ ২০১৪ সালের ৮ জুন সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব কমিটির সভায় সংস্থাটি গঠনের নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদনের ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন কিংবা তার কোনো কার্যক্রমে অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ রংপুরবাসী।

সরেজমিন রংপুর মহানগর ঘুরে দেখে বোঝার উপায় নেইÑএটি একটি বিভাগীয় জেলা শহর। এই মহানগরের রাস্তাঘাটের কিছুটা উন্নয়ন হলেও হিসাব মিলবে না দৈর্ঘ্য-প্রস্থে। ঘোষণা ও কাগজপত্রে মহানগরের প্রধান সড়কটি ৬৫ ফুট প্রশস্ত হলেও স্থানভেদে কোথাও কম আবার কোথাও বেশি। চোখে পড়বে রাস্তার ওপর বিদ্যুতের পোল। একই পোলে ঝুলছে বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ইন্টারনেট ও ডিসের সংযোগ লাইন। রংপুর বিভাগ প্রতিষ্ঠার যুগ পেরুলেও যেন এখনও পুরো মহানগর রয়েছে অগোছালো।

রংপুর মহানগরের বিভিন্ন এলাকার মূল সড়ক পিচঢালা হলেও অলিগলির সবই এখন ঢালাই করা। হয়েছে উন্নত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বাড়ি বাড়ি রয়েছে ডাস্টবিন। তবে আগের চেয়ে বেড়েছে মানুষের বসবাস। সঙ্গে বেড়েছে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতাও। নগর উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় পুরো নগরীর যত্রতত্র ইচ্ছেমতোই গায়ে ঘেঁষে উঠছে ভবনের পর ভবন।

১০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস রংপুর মহানগরীতে। অথচ কোথাও কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই। নগরীর সচেতন মহল বলছে, আবাসিক ভবন কোথায় হবে, বাণিজ্যিক ভবন কোথায় হবেÑএ ধরনের কোনো নির্দেশনাও নেই। ফলে যত্রতত্র ইচ্ছেমতোই চলছে নগরায়ণ। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমানহারে আশপাশের জেলা থেকে মানুষ আসছে রংপুরে। পাল্লা দিয়ে নগরজুড়ে বাড়ছে যানজট।

অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘরের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে হোটেল, মোটেল, মার্কেট, ছোট-বড় কলকারখানা, আবাসিক ভবন বা বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে করে শহরের সৌন্দর্য বাড়ছে না। বরং বাড়ছে ইট-বালু আর রড-সিমেন্টের জঞ্জাল। দিন দিন রংপুর পরিণত হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা নগরীতে। লোকবল সংকটের কারণে পুরো নগরীর কর্মকাণ্ড তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না।

সচেতন মহল বলছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল আজ অবধি রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখনও অগোছালো রংপুর মহানগরী। আধুনিক নগরায়ণের জন্য যে মাস্টারপ্ল্যান থাকা অত্যাবশ্যকীয় সেটাও এখনও করা হয়নি। ফলে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র বিল্ডিংসহ যাবতীয় স্থাপনা গড়ে উঠছে যেভাবে, তাতে একসময় রংপুর নগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই দ্রুত রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নের দাবি রংপুরবাসীর।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, একটি আধুনিক নগরের প্রথম শর্ত হচ্ছে পরিবেশবান্ধন পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন। রংপুর মহানগরকে উন্নত নাগরিক সুবিধা, তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধন হিসেবে গড়ে তুলতে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া রংপুরে উন্নয়নের মূল স্রোতোধারায় সম্পৃক্ত করা সম্ভব। কিন্তু কেন এটাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না, এটা ভাবার বিষয়।

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংগঠক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, দেশের অন্যতম অপরিকল্পিত নগরগুলোর একটি রংপুর। এই নগরকে পরিকল্পনার আওতায় আনতে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করার কথা ছিল। অথচ ৯ বছরেও এটি বাস্তবায়ন হয়নি। যেভাবে রাস্তা নির্মাণে যানজট কমবে, জলাবদ্ধতা কমবে সেই উপায়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু সেই মাস্টারপ্ল্যান নেই। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন, রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরিসহ রংপুরকে ঢেলে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হোক।

এ বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, ২০১২ সালে সিটি করপেরেশন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর সিটি করপোরেশনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করার একটা বাধ্যবাধকতা থাকে। তারই আলোকে আমরা প্রস্তাবনা পাঠাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। সেই প্রস্তাবনার আলোকে এলজিইডি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রংপুর সিটির করপোরেশনের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। পরে সেটি সিটি করপোরেশন কর্তৃক অনুমোদন করে ২০১৪ সালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গেজেট নোটিফিকেশনের জন্য পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত সেই গেজেট হয়নি। ২০২২ সাল থেকে আবারও শোনা যাচ্ছিল যে রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন হবে। তারই আলোকে গত বছর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে একটি চিঠি দেয় মতামত জানার জন্য। তারই পরিপেক্ষিতে গত বছরের মার্চ মাসে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দ্রুত করার পক্ষে মতামত প্রদান করা হয়। সেই মতামত প্রদানের প্রায় দেড় বছর হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি। বর্তমানে মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় রংপুরকে পরিকল্পিত নগরী করা সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

এদিকে দ্রুত ‘রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠনের তাগিদ জানিয়ে এরই মধ্যে লিখিত মতামত অধিদপ্তরে পাঠিয়েছে রংপুর সিটি করপোরেশন। রংপুর উন্নয়ন প্রকল্প এবং নগরীকে ঘিরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে রংপুর সিটি করপোরেশন মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, রংপুর সিটি করপোরেশন গঠন হওয়ার পর অনেক কিছুই এখনও হয়নি। পৌরসভা থেকে যখন সিটি করপোরেশন উন্নীত হয়, তখন একটি মাস্টারপ্ল্যান হয়। মাস্টারপ্ল্যানটি এখনও অনুমোদন হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের রিপোর্টটি চলতি বছরে আট-নয় মাস আগে পাঠানো হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। এখন পর্যন্ত সেটাও অনুমোদন হয়নি। আমরা দৈনিক ভিত্তিতে কিছু লোক নিয়ে মানুষের সার্ভিসটা জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছি। মন্ত্রণালয় থেকে যখন যেটা চায় আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা দিই। দেয়ার পর অনুমোদনের বিষয়টি তো সরকারের বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। যতক্ষণ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়নি, ততক্ষণ পর্যন্ত হ্যাঙ্ক আছে। বর্তমানে বিলুপ্ত পৌরসভার জনবল কাঠামো দিয়েই সিটি করপোরেশন চলছে। নতুন জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়নি। রংপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং নগরকে ঘিরে কোনো মাস্টারপ্ল্যান না থাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০