লালমনিরহাট ও নীলফামারীতে পানিবন্দি ২৫ হাজার পরিবার

প্রতিনিধি, লালমনিরহাট ও নীলফামারী: তিস্তা নদী থেকে অর্ধকিলোমিটার দূরের পাকা সড়কের উঁচু স্থানে বসে ভাত রান্না করছেন আকলিমা খাতুন ও তার ষাটোর্ধ্ব শাশুড়ি। গত শনিবার তাদের বাড়িতে কোমরসমান পানি উঠেছে। চাল-ডাল ও সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছিলেন।

আমতলা এলাকায় সড়কের ওপর দিয়ে তীব্র স্রোত চলে যাচ্ছে তিস্তা নদীর দিকে। এ সড়কে সকালের দিকে আরও বেশি পানি ছিল। কেউ বের হতে পারেননি। এখন বিকাল বেলা পানি একটু কমেছে, টান ধরেছে নদীর দিকে। সড়কে তবুও হাঁটুপানি। সেই পানি পার হয়ে বাড়ি থেকে বাজার-সদাই কিনতে সব বয়সী মানুষ হাটবারের হাটে যাচ্ছে। তিন দিনের বন্যায় তারা এখনও কোনো ত্রাণসহায়তা, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাননি।

হাসিনা বেগম, আজিজুল ইসলাম, আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘তিন দিন হলো পানি আসছে। ক্ষেতখামার সব তলিয়ে গেছে। কোনো সরকারি লোক আসে নাই। এক ফোঁটা ত্রাণ দেয় নাই। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা আসে নাই।’ গতকাল সরেজমিন এমন চিত্রই ওঠে আসে। ভারত থেকে আসা ঢল ও টানা বৃষ্টিতে তিস্তার পানি বেড়েছে। বর্তমানে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। এতে লালমনিরহাট জেলার পাঁচ উপজেলার ২০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে লালমনিরহাট-সান্তাহার রেলপথের প্রায় অর্ধকিলোমিটার রেললাইন। এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়েই চলছে ট্রেন। পানি ওঠায় বন্ধ রয়েছে ১৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান।

রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে সকাল ৬টায় ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সকাল ৯টায় পানি কমে গিয়ে ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বেলা ৩টায় ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তার দোয়ানী ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে, ভাটিতে থাকা তিস্তা রেল সেতু পয়েন্টে সকাল ৬টায় ২৯ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ৩১ সেন্টিমিটার এবং বেলা ৩টায় ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের জলপাইগুড়ি ১৬৪, কালিম্পং ১৩০, দার্জেলিং ৭৭, কুচবিহারে ৫৪ দশমিক শূন্য মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ভারত থেকে আসা ঢলের কারণে তিস্তা ব্যারাজের উজানে থাকা পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম ইউনিয়নের লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। রোপা আমনসহ শীতকালীন আগাম সবজি। ক্ষতি হয়েছে শীতকালীন বীজতলার।’

ভাটিতে থাকা কালীগঞ্জ, আদিতমারী, লালমনিরহাট সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার ফসলের মাঠ পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। এতে ওই এলাকার আগাম জাতের ফসলের ক্ষতি হয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া দপ্তরের প্রধান আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আগামী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকবে। কিছু এলাকায় দমকা হাওয়াসহ মাঝারি ও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।’

এদিকে লালমনিরহাট আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের বন্যার্তদের মাঝে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে লালমনিহাট জেলার পাঁচ উপজেলার জন্য শিশুখাদ্যের জন্য ৫ লাখ নগদ টাকা, ১৩ লাখ নগদ টাকা ও ৯০ টন চাল বরাদ্দ করেন। এ বরাদ্দের মধ্য থেকে আদিতমারী উপজেলা প্রশাসনের জন্য তিন লাখ নগদ টাকা ও ১০ টন চালের বরাদ্দ পায়।


মহিষখোঁচা ইউনিয়ন পরিষদে নগদ অর্থ বরাদ্দের সময় আদিতমারী উপজেলার এসিল্যান্ড রওজাতুন জান্নাত, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আপাতত ৩ লাখ টাকা ও ১০ টন চালের বরাদ্দ পাওয়া গেছে। আমরা বিতরণ শুরু করেছি।’ বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সমাজসেবী সংগঠন, এনজিওসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম চালানো হয়। এবার কোনো প্রকার ত্রাণ পাচ্ছে না বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন। মহিষখোঁচা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমার এলাকায় তিন দিনের বন্যা চলছে। গতকাল সন্ধ্যায় ত্রাণের নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। তবে কোনো এনজিও বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো সহযোগিতা বন্যাকবলিত স্থানে এখন পর্যন্ত পাইনি।’
জেলা প্রশাসক এইচএম রকিব হায়দার বলেন, ‘লালমনিরহাট জেলায় মোট ১৮ লাখ টাকা আর ৯০ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। লালমনিরহাটে এটাই সর্বোচ্চ বরাদ্দ।’

আমাদের নীলফামারী জানান, নীলফামারীতে চার দিনের ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও লোকজনের ভাষ্য, তিস্তার পানি বাড়ার কারণে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছ চাপানী, গয়াবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তিস্তা নদী বেষ্টিত ১৫টি চর গ্রামের পাঁচ হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

পূর্বছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে গতকাল তিস্তা নদীর পানি বাড়ে; যা গতকাল রোববার সকাল ৯টা পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এতে তার ইউনিয়নের পূবছাতনাই ও ঝাড়সিংহেরস্বর মৌজার প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। পানি বাড়া অব্যাহত থাকায় লোকজন আতঙ্কে আছেন।

খালিশাচাপানী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘দুদিন ধরে তিস্তায় পানি বাড়ছে। আজ সকাল পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তিস্তাপাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম বাইশপুকুর গ্রামে দেড় শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারী ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুর রহমান বলেন, ‘আজ সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও সকাল ৯টায় ৩ সেন্টিমিটার কমে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। পূর্বাভাস অনুযায়ী পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সব কয়টি (৪৪টি) জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০