লাল কালিতে মৃত্যু পরোয়ানা ঝুলছে দুপাশের বৃক্ষের

দ্বিপাল ভট্টাচার্য্য, সুনামগঞ্জ :‘সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান, মরুর দারুণ দুর্গ হতে; যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে। সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায়, দুস্তর শৈলেরে বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বিজয় অখ্যান লিপি লিখে দিলে পল্লব-অক্ষরে। ধূলিয়ে করিয়া মুগ্ধ, চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে ব্যাপিলে অর্পণ পন্থা’Ñবৃক্ষ বন্দনা কবিতায় এমন শত কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু এসব বৃক্ষ-লতা বন্দনার সময়-সুযোগ নেই বন বিভাগের বন রক্ষকদের। তাই তো তারা সামাজিক বনায়নের দোহাই দিয়ে একসঙ্গে ১৯ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশের সারি সারি বৃক্ষ কাটার আয়োজন করছেন।

জানা যায়, সুনামগঞ্জের-সাচনাবাজার ১৯ কিলোমিটার সড়কের দুপাশের দৃশ্য যথারীতি মনোমুগ্ধকর। সুবিশাল কাণ্ডে বৃক্ষগুলো এই মায়াবী পথের ছায়া-মায়ার কারুকাজ হয়ে আছে যেন। কিন্তু আনন্দময় এই প্রকৃতিদর্শন অচিরেই বিষাদে ভরে উঠল! কেন? যখন আমরা বুঝতে পারি এই মহিরুহ বৃক্ষগুলো প্রতিমুহূর্তেই মৃত্যুর প্রহর গুনছে! কারণ, তাদের গায়ে ঝুলছে লাল রঙের নম্বরসংবলিত মৃত্যু পরোয়ানা। ডেথ সেলের কয়েদিদের মতো ওদের যদি জিজ্ঞেস করা যেত ‘তোমাদের শেষ ইচ্ছাটুকু কী’Ñআর যা-ই হোক, ওরা নিশ্চয় এমন মৃত্যু চাইত না। টুকেরবাজার থেকে সাচনাবাজার সড়কের দুপাশের সব গাছের জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে বনবিভাগ। এরই অংশ হিসেবে প্রতিটি গাছে লাল কালিতে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জেলা বন বিভাগ জানিয়েছে, এই ১৯ কিলোমিটার রাস্তায় যে বৃক্ষগুলো আছে, সেগুলো সামাজিক বনায়নের আওতায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রোপণ করা হয়েছিল। সামাজিক বনায়নের বিধিমালা অনুযায়ী অংশীদারত্বমূলক বনায়নের সর্বনিম্ন বয়স ১০ বছর আর সর্বোচ্চ ২০ বছর। কিন্তু গাছগুলোর বয়স ২০ বছরেরও অধিক, তাই এখন কাটতেই হবে। সবুজে মোড়া হাজারো গাছের সমারোহ এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের প্রাণ। লাখ লাখ পথচারীর অক্সিজেন আর আশ্রয়। কিন্তু পথচারী কিংবা এলাকার মানুষ জানেনই না তাদের অক্সিজেনদাতা বৃক্ষগুলো কাটার জন্য চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।

স্থানীয় বাসিন্দা ও গাড়িচালক মনির হোসেন অবাক হয়ে বলেন, ‘গাছ কাটা হবে, এই খবর আমরা জানিই না। এই গাছগুলো আমাদের জীবন বাঁচায়। এদের আশ্রয় করেই আমরা টিকে আছি। আমাদের মানবজাতির অক্সিজেন হলো গাছ। এই গাছগুলো কাটলে আমাদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। আমরা চাই গাছগুলো বেঁচে থাকুক।“

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার টুকেরবাজার থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজার পর্যন্ত সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের দুপাশে লাগানো বৃক্ষ নিধন করার প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে গাছ বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে বন বিভাগ। এই খবর জানার পরপরই স্থানীয় লোকজনের উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। একসঙ্গে এত গাছ কাটার কথা শুনে অনেকেই বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এক সড়কে এত গাছ কাটার বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এই বিষয়টি সড়ক ও জনপথ বিভাগের দায়িত্বে। তবুও মানুষের প্রত্যাশার কথা বিবেচনা করে সড়ক ও জনপথ সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।

এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম প্রামাণিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তাকে পাওয়া যায়নি। তাই বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা নদীর আবদুজ জহুর সেতু থেকে টুকেরবাজার পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সড়কের দুপাশে তেমন গাছ নেই। টুকেরবাজার থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিয়ামতপুর হয়ে সড়কটি জামালগঞ্জের সাচনাবাজার পর্যন্ত গেছে। সড়কের বেশিরভাগ অংশ সদরে। দুই পাশে সারি সারি গাছ। টুকেরবাজার থেকে গাছে নম্বর দেয়া শুরু হয়েছে। সদরের উমেদশ্রী, নিধিরচর, ইচ্ছারচর, ইসলামপুর, বেড়াজালি, আহমদাবাদ; বিশ্বম্ভরপুরের দুলবারচর, সংগ্রামপুর এবং জামালগঞ্জের শেরমস্তপুর ও নজাতপুর থেকে সাচনাবাজার পর্যন্ত প্রতিটি গাছে নম্বর দেয়া।

স্থানীয়রা মনে করতেন, এই লাল চিহ্নিত নম্বরগুলো গাছ গণনার জন্য দেয়া হয়েছে। গাছগুলো কাটা হবে, এ কথা শুনে বিস্মিত হয়ে টুকেরবাজারের ব্যবসায়ী (মুদির দোকান) দেবল দাস বলেন, এসব আমরা জানি না। এটা জানি, গাছগুলো আমাদের সম্পদ। এগুলো না কাটলে সুফল ভোগ করব আমরা সবাই।

বন বিভাগ সুনামগঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা বলেন, বিধিমালা অনুযায়ীই গাছগুলো কাটতে হবে। রাস্তায় সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গাছ লাগানো হয়েছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা গাছের পরিচর্যা করেছেন। সামাজিক বনায়ন বিধিমালা-২০০৪ অনুযায়ী, গাছ বিক্রির টাকা উপকারভোগী ৫৫ ভাগ, বন অধিদপ্তর ১০ ভাগ, ভূমির মালিক হিসেবে সওজ ২০ ভাগ ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) পাঁচ ভাগ পাবে। বাকি ১০ ভাগ টাকা দিয়ে আবার বনায়ন করা হবে।

গাছগুলো কবে কাটা শুরু হবেÑএমন প্রশ্নে দ্বীন ইসলাম জানান, সেটা বলা যাচ্ছে না, তবে দরপত্রের কার্যক্রম শেষ হলেই পর্যায়ক্রমে গাছ কাটা শুরু হবে এবং এক-দেড় বছর সময় লাগবে।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান গাছ কাটার কথা শুনে বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এত গাছ কাটবে কেন? পরে আবার লাগানোর চেয়ে এগুলো কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেই পথ খোঁজা উচিত। প্রশাসন স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরাও থাকব। প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষদের সরকার অন্যভাবে সুবিধা দিক। তবু হাজার হাজার গাছ কাটার উদ্যোগ বন্ধ করা দরকার।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০