Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 12:57 am

লোকমানের ক্যাসিনো আছে জানতেনই না পাপন!

ক্রীড়া প্রতিবেদক: হঠাৎ করেই ক্যাসিনো কাণ্ডে উত্তাল বাংলাদেশ। আলোচনায় ঢাকার ক্রীড়াঙ্গন। বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবগুলোর থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে। খেলা আয়োজনের আড়ালে ঢাকার বেশিরভাগ ক্লাবই জড়িয়ে আছে জুয়া আর ক্যাসিনোতে। রাজধানীতে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সঙ্গে বেশকিছু ক্লাবের জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে। এরই মধ্যে গ্রেফতারও হয়েছেন বিসিবির পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। তার আগেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আরেক প্রভাবশালী পরিচালক ও বিসিবি সহসভাপতি মাহবুব আনামকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার সম্পদের হিসাবে গরমিল পাওয়ায় ডাক পড়েছে দুদকে।
লোকমান আটক, মাহবুবকে দুদকে তলব নিয়ে বিব্রত বিসিবি। যদিও মিরপুরের শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বিসিবি হেডকোয়ার্টারে এ নিয়ে প্রকাশ্যে কেউ কিছুই বলছেন না। চাপ উত্তেজনা আর লুকোচাপার পরও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে অন্য কর্মকর্তাদের।
দুদুক এরই মধ্যে জানিয়েছেÑতাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মাহবুবুল আনামের নামে চার কোটি ৭৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকার স্থাবর আর ৫৬ কোটি ৭৬ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৬২ কোটি ৫৪ লাখ ৮২ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য মিলেছে। এ সম্পদের গ্রহণযোগ্য উৎস কী, সেটা জানতে চেয়ে দুদক তাকে নোটিস দিয়েছে।
লোকমান হোসেন ভূঁইয়া আরও বড় আকারেই ফাঁসছেন। কারণ সরাসরি ক্যাসিনো কাণ্ডে উঠে এসেছে তার নাম। র‌্যাব জানিয়েছে, মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনো বসানোর ভাড়া হিসেবে তিনি মাসে ২১ লাখ টাকা পেতেন। আর এ অর্থ লোকমান তার নিজের বিদেশি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাচার করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার দুই ব্যাংকে তার জমা আছে প্রায় ৪১ কোটি টাকা!
এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর গত বুধবার রাতে র‌্যাব লোকমানের বাসায় তল্লাশি চালিয়ে তাকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি থেকে বিদেশে অর্থ পাচার-নিজের সব কৃতকর্ম স্বীকার করেন লোকমান!
বোর্ডের দুই প্রভাবশালীর হঠাৎ এভাবে ভিন্ন কারণে আলোচনায় আসার খবরে চোখ থাকছে বিসিবির। তবে এখনই এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপে যাচ্ছে না তারা। বিসিবির সিইও নিজামুদ্দিন চৌধুরী সুজন গতকাল শেয়ার বিজ প্রতিবেদককে বলেন, ‘দেখুন, এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এ নিয়ে বিসিবির কিছু বলার নেই। বোর্ড তার নিজস্ব নিয়মে চলবে। আর তারা দুজন যে ব্যাপারে অভিযুক্ত হয়েছেন সেটা ক্রিকেটের কোনো বিষয় নয়। এটা আইনের নিজস্ব গতিতে চলবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে এ প্রসঙ্গ নিয়ে মন্তব্য করবেন না।’
কিন্তু এটাও ঠিক বিসিবিতে বড় দুটো দায়িত্বে আছেন তারা। মাহাবুব আনাম গ্রাউন্ডস কমিটির চেয়ারম্যান, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য, পূর্বাচলে প্রস্তাবিত শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য। আর লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ফ্যাসিলিটিজ কমিটির চেয়ারম্যান, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য আর পূর্বাচলে প্রস্তাবিত ৮০০ কোটি টাকা বাজেটনির্ভর শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য।
চলমান এ প্রক্রিয়াগুলো এখন লোকমান-মাহবুবকে ছাড়াই কী চলবে? বিসিবির সিইও সুজন জানাচ্ছিলেন, ‘বিসিবির সংগঠকের বাইরে তাদের আলাদা একটা পরিচিতিও আছে। সেই পরিচয়ের কারণে এভাবে আলোচনায় এসেছেন তারা। আর বিসিবি একটি বড় প্রতিষ্ঠান। এর কোনো কাজ বসে থাকবে না। সব কিছুই যথানিয়মে এগিয়ে যাবে।’
লোকমান হোসেনকে ফুটবলের মানুষ হিসেবেই চিনতেন সবাই। দীর্ঘদিন ধরেই জড়িয়ে আছেন মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ২০১১ সালে লিমিটেড কোম্পানি হলে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হন তিনি। লোকমান প্রথম ক্রিকেট বোর্ডের কমিটিতে পা রাখেন ২০১২ সালে। তখন ১৩ সদস্যের অন্তর্বর্তীকালীন কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন বিসিবির বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এ কমিটির একজন সদস্য হিসেবে হন লোকমান। তারপর ২০১৩ সালের অক্টোবরে ও ২০১৭ সালের অক্টোবরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বি^তায় বোর্ড পরিচালক হন লোকমান।
তিনি যে বিসিবির সভাপতি নাজমুল হাসানের ঘনিষ্ঠ সেটা সবারই জানা। তার হাত ধরেই একাধিক বড় কাজও পেয়েছেন লোকমান। বিসিবির পরিকল্পনাধীন শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির পাঁচ সদস্যের কমিটিরও একজন তিনি। বিসিবির স্থাপনাসমূহের অবকাঠামোগত সংস্কার, নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন হয় লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বে। তবে এ দফায় নিজের চেয়ারটা যে টলমলে তা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার।
তবে এখনও লোকমানকে নিয়ে বিব্রত হওয়ার কিছু দেখছেন না বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। গতকাল শুক্রবার গুলশানে নিজের বাসভবনে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। যেটা বুঝি যে কেউ যদি অন্যায় করে থাকে তাহলে তার শাস্তি হবে। এটাতে তো কারও কোনো দ্বিমত হওয়ার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী যে পদক্ষেপটি নিয়েছেন এটাকে ভালো না বলার কোনো কারণ নেই। লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ক্লাব ভাড়া দিয়েছে। সে যদি ক্যাসিনোর জন্য ভাড়া দিয়ে থাকে আর সেটির সঙ্গে যদি তার সংশ্লিষ্টতা থাকে তাহলে বিচার হবে।’
নাজমুল হাসান অবশ্য মেনে নিয়েছেন, তার হাত ধরেই বিসিবিতে পা রাখেন লোকমান। এ নিয়ে প্রশ্নটা উঠতেই গতকাল বলেন, ‘দেখুন, আমি যে লোকমানকে চিনি সে জীবনে মদ খায়নি। সে জীবনে কোনো দিন জুয়া খেলেনি। কিন্তু এটাও সত্যি যে সে ক্যাসিনো ভাড়া দিয়েছে। আমরা তাকে যেভাবে চিনি এবং জানি, সেটাই বললাম। এখন প্রমাণিত হওয়ার আগে তো আমরা কিছু বলতে পারছি না যে আসলে ঘটনাটা কী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে, দেশে আইন আছে। তারা আগে দেখুক, বুঝুক। যে দোষ করেছে তার শাস্তি হবে।’
তবে এখনই লোকমানের ব্যাপারে শাস্তিমূলক কিছু করা নিয়ে ভাবছে না বিসিবি। নাজমুল হাসান জানাচ্ছিলেন, ‘আমাদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কিছু নেই। যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তখন অবশ্যই বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এখনই এটা নিয়ে বলা ঠিক হবে না। আমার কথা হচ্ছে যদি কেউ অন্যায় করে থাকে তাহলে তার বিচার হবে। এখানে কোনো ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। আমি বিসিবিতেও ছাড় দেব না। তবে আমাকে লোকমান কোনো দিন বলেনি যে ক্লাবে একটি ক্যাসিনো আছে। এটা কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার। সে কিন্তু আমার বন্ধু।’
এমন ‘অক্রিকেটীয়’ আলোচনা নিয়ে বিব্রত বিসিবির অন্য পরিচালকরাও। কিন্তু কেউই সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ। অফিসিয়ালি কিছুই বলছেন না। তবে এর মধ্য দিয়ে ক্লাবগুলোতে শুদ্ধি অভিযানও হবে বলে মনে করছেন অনেকে। বোর্ড পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি এরই মধ্যে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমি মনে করি, এটিই ক্লাবগুলোকে পুনর্গঠনের সুবর্ণ সুযোগ। সত্যিকারের সংগঠকদের হাতে ক্লাব আর সব ক্রীড়া সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দিলে ভবিষ্যতে আর এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না।’