Print Date & Time : 27 June 2025 Friday 1:23 pm

লোকসংখ্যা ও আবাসনে অধোগতি

ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-১৩

মিজানুর রহমান শেলী: নদীতীরে গড়ে ওঠার কারণে এ ঢাকা শহরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল অনেক। আর বাণিজ্যিক গুরুত্ব এ অঞ্চলের আবাসন-রীতিতে পরিবর্তন ও বিবর্তন নিয়ে আসে বহুরূপে। সুলতানি আমলেই এখানে বাণিজ্যের রমরমা পরিসর গড়ে ওঠে। তারপর আবার রাজধানী স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে এখানে জনসংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ১৬৪০ সালে সেবাস্টিয় ম্যানরিক উল্লেখ করেন, ঢাকা শহর ও শহরতলিতে লোকসংখ্যা ছিল দুই লাখ। ১৭৮৬ সালে ঢাকার কালেক্টর ও ১৮০০ সালে ঢাকার কমার্শিয়াল রেসিডেন্টেও একই হিসাব উল্লেখ করা হয়। তবে ম্যানরিক ১৬৪০ সালে জনসংখ্যার যে বিবরণ দেন, তা অনুমাননির্ভর এবং তা শহর ও শহরতলি মিলে। ১৭৮৬ সালে ঢাকার কালেক্টর প্রায় দুই লাখের কথা অনুমান করে উল্লেখ করে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ঢাকা শহরের পরিধি বেড়ে গিয়েছিল অনেক। ব্যবসা-বাণিজ্যে ভিনদেশিদের আনাগোনাও বেড়েছিল বিপুল। সুতরাং জনসংখ্যা বাড়ছে সহজেই অনুমান করা চলে। এমনকি আবাসনও বেড়েছিল বলে প্রমাণ মেলে। তাই কালেক্টরের তথ্য ও মানরিকের তথ্য একই শর্তে সাদৃশ্য বলা চলে না। তবে ১৮০০ সালে ঢাকার কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তার তৈরি রেকর্ড অনুযায়ী উল্লেখ করা হয়। তাই এই তথ্যটি নির্ভরযোগ্য বলে ধারণা করা যায়। তাতে বলা চলে, কেবল শহরাঞ্চলেই লোকসংখ্যা দুই লাখ ছিল। অর্থাৎ ঢাকা শহরের বিস্তৃতি বাণিজ্য ও প্রশাসনিক বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছিল, তা নিশ্চিত করে বলা চলে। এমনকি তাদের জন্য আবাসনে ও স্থাপত্যরীতিতেও নানামুখী বিবর্তন হয়েছে।

আরব, ইরান, চীন, আর্মেনিয়া, মালয়, জাভা, সুমাত্রা থেকে এখানে বণিকরা এসেছেন দলে দলে। আবার পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজরাও এখানে এসে কল-কারখানা গেড়ে বসেছে। সেনা, নৌ ও প্রশাসনিক লোকের বাইরেও এখানে এসেছেন কারিগর, উৎপাদক, বিভিন্ন পেশাজীবী, মহাজন ও মাড়োয়ারি ব্যাংকাররা এখানে এসেছেন।

তবে বসতি গড়ে তোলার দিক দিয়ে পর্তুগিজরাই এ ঢাকায় সর্বপ্রথম ইউরোপিয়ান। তারা ঘরবাড়ি ও গির্জা নির্মাণ করেন। সব ইউরোপিয়ানই প্রথমে ভাগীরথিকে কেন্দ্র করে কলকাতায় ঠাঁই নিলেও তাদের উৎপাদনকেন্দ্র ছিল ঢাকা। এখানে মসলিনসহ আরও অনেক বস্ত্রশিল্প প্রসিদ্ধি লাভ করে। তাই ইউরোপীয়রা ঢাকায় প্রচুর পরিমাণ সোনা ও রুপার পিণ্ড আমদানি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮০০ শতকে ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকার বস্ত্র রফতানি করে।

এরপর ১৮০০ সালের পরই বাংলায় নওয়াবদের ক্ষমতা লোপ পায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান ঘটে ১৮০০ শতকের শেষভাগে। এই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও উৎপাদননীতি নগরীর আর্থিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বেকার হয়ে পড়েন। বিকল্প কর্মসংস্থানে তারা অন্য এলাকা বা পল্লি গাঁয়ে চলে যান। ঢাকার জনসংখ্যাও তাই দ্রুত হ্রাস পায়। ফলে নগরীর স্বাভাবিক বিস্তার মুখ থুবড়ে পড়ে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক সব দিক দিয়ে ঢাকা হয়ে পড়ে আগের রূপের মলিন ছায়া-ংসদৃশ।

অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য এবং মসলিন উৎপাদন ছিল মোগল আমলে ঢাকার উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি। সে সঙ্গে ঢাকাকে একটি সমৃদ্ধ উপ-রাজধানী হিসেবেও মোগলরা গড়ে তোলেন। তাই এখানে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে এখানে জনসংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছিল অনেক। শহরতলিসহ ঢাকার তখন লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লাখ। এ বিপুল জনগোষ্ঠীতে ছিলেন অভিজাত শ্রেণি, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, সৈনিক, কারখানা মালিক, বণিক ও বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবী-চাকরিজীবী। তাই এত লোকের কর্মসংস্থানে যেমন শহরের বিস্তার ছিল অত্যাবশ্যক, তেমনি তাদের আবাসনের জন্য প্রয়োজন হয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা ও বিভিন্ন ধরনের আবাসস্থল।

বুড়িগঙ্গা বরাবর সাত বা ১০ মাইল, অভ্যন্তরভাগ আড়াই মাইল। শহরতলির বিস্তার ঘটে বুড়িগঙ্গা থেকে টঙ্গী ব্রিজ অবধি ১৫ মাইল। পশ্চিমে মিরপুর-জাফরাবাদ থেকে ১০ মাইল পূর্বে পোস্তগোলা। এ বিশাল এলাকায় ছিল বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক অবকাঠামো। সে সঙ্গে জমে উঠেছিল বিভিন্ন রীতি-আদলের আবাসন। এখানে বাইজেন্টাইন, পারসিক, ভারতীয় ও স্থানীয় রীতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে এক সমৃদ্ধ অবকাঠামো। অর্থাৎ রাজধানীর সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন যত বাড়ছিল, ততোই লোকসংখ্যা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ত্বরান্বিত হচ্ছিল।

এই ধারা থমকে যায় ঢাকার প্রশাসনিক-রাজনৈতিক কাঠামোর পালাবদল ঘটার সঙ্গে সঙ্গে। এটা ছিল ভাগ্য বিপর্যয়। ইংরেজের শাসন যখন নেমে এলো। ফলে জনগোষ্ঠী যেমন কমে এলো, তেমনি প্রাকৃতিক সীমানার ওপরও চরম প্রভাব পড়ল।

জনসংখ্যার অধোগতি ১৮০১ সালে জনসংখ্যা ছিল যেখানে দুই লাখ, সেখানে ১৮৪০ সালে কমে দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৬৩৬ জন। অর্থাৎ এ ৪০ বছরে এক লাখ ৪৮ হাজার ৩৬৪ জন লোক ঢাকা ছাড়ল।

শতকরা হিসেবে মাত্র ৪০ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছিল ১০০ ভাগের ৭৯ ভাগ। ঢাকার পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিকে  নারিন্দা, ফরিদাবাদ, উয়ারী ও আলমগঞ্জ এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। অন্যদিকে উত্তরের ফুলবাড়িয়া, দেওয়ানবাজার, মনোহরখান বাজার এবং পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমের ঢাকেশ্বরী, আজিমপুর ও এনায়েতগঞ্জ একেবারেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। মেরামতের অভাবে দোলাই নদীর ওপরে বিশাল বিশাল সেতুগুলো একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়।

তবে ১৮০৩ সালে ঢাকাবাসীর চিকিৎসার জন্য ব্রিটিশরা ন্যাটিভ হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৮ সালে টেইলর উল্লেখ করেন, এটা ছিল খুবই ছোট। খোলা জায়গায় চিকিৎসা দেওয়া হতো। তেমন উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। নামমাত্র চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। মাত্র ৪৯ জন রোগী একসঙ্গে চিকিৎসা নিতে পারতেন। এ হাসপাতালে এসে রোগীদের রোগ আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় প্রকট থাকত।

যাহোক, ১৮৪০ সাল থেকে ঢাকায় আবার উন্নয়নের নতুন ধারা শুরু হলো। ঢাকার নগর ইতিহাসে এ এক নতুন অধ্যায়। এ উন্নয়নের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ফরাসি বিপ্লব, রোমান্টিসিজম তথা উনিশ শতকের (তথাকথিত) বাংলার নবচেতনা। তবে এ উন্নয়নে সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ হিসেবে যে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছে, তা হলোÑ১. সমগ্র দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার সম্পদশালী পশ্চাৎভূমি, ২. উপযুক্ত ভৌগোলিক অবস্থান, ৩. প্রশাসনিক উন্নতি, ৪. নতুন শিক্ষা কাঠামো, ৫. ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ৬. উৎপাদন ও শিল্প-কারখানা। কার্যত ব্রিটিশরা ঢাকার প্রতি মোগল-মুসলিম ভীতি থেকে একটু দমিয়ে রাখা নীতি অবলম্বন করে আসছিল। কিন্তু পুরোপুরি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার পর আর তারা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবল না। তখন এই ঢাকার ঐশ্বর্যভাণ্ডারের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি ফেললেন। ঢাকার প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক সমৃদ্ধি থেকে লাভবান হওয়ার জন্যই তারা এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে সচেষ্ট হলো। ফলে পতিত ঢাকা নগরীতে আবার চাঞ্চল্য কিছুটা ফিরে এলো। এখানে আবার ব্যবসায়িক কাজে মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকল। জনসংখ্যা সামগ্রিকভাবে বাড়ল। ইংরেজরাও তাদের প্রশাসনিক কাজের প্রয়োজনে অবকাঠামো ও আবাসন বাড়াল। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়েও এখানে লোকসংখ্যা ও আবাসন বেড়েই চলল।

লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ