লোকসানি পিডিবি থেকে ১০ গুণ উৎসে কর কেটে নিচ্ছে এনবিআর!

ইসমাইল আলী: নিজস্ব কেন্দ্রে উৎপাদনের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎ কিনে বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বেশি দামে কিনে কম দাম বিদ্যুৎ বিক্রি করায় প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান গুনছে সংস্থাটি। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সংস্থাটির পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার কোটি টাকা। এরপরও পিডিবি থেকে ছয় শতাংশ হারে উৎসে কর কেটে নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে এ হারে কর কাটা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে গত অর্থবছর পিডিবির প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা কেটে নিয়ে গেছে এনবিআর। যদিও শেষ হওয়া অর্থবছর পিডিবির লোকসান রেকর্ড ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর সেবামূলক লোকসানি সরকারি সংস্থার জন্য উৎসে কর শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ পিডিবি থেকে ১০ গুণ বেশি হারে উৎসে কর কাটছে এনবিআর।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালের অর্থ আইনে বিদ্যুৎ খাতের ওপর ছয় শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করেছে এনবিআর। তবে মুনাফায় থাকার পরও বিপিসির আওতাধীন কোম্পানিগুলোর উৎসে কর দিতে হয়েছে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ হারে। অথচ পিডিবির ক্ষেত্রে তার উল্টোটাই করেছে এনবিআর। লোকসানি হওয়া সত্ত্বেও পিডিবির ওপর ছয় শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করেছে এনবিআর। এতে সংস্থাটির লোকসানের বোঝা বেড়েছে। গত অর্থবছর একাধিকবার উৎসে কর মওকুফের আবেদন করেছে সংস্থাটি। তবে বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না এনবিআর।

এর পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির জন্যও বিপিসির মতো শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ উৎসে কর নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পরে সে চিঠি বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন সংস্থাকে দেয়া হয়েছে।

চিঠির বলা হয়েছে, পিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার), রেন্টালভিত্তিক বিদ্যুৎ কোম্পানি, সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি ও ভারত থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে বিইআরসি কর্তৃক নির্ধারিত হ্রাসকৃত বিভিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি/সংস্থার কাছে বিক্রি করে। এতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে। ৩০ জুন ২০২১ সমাপ্ত অর্থবছর পর্যন্ত পিডিবির পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ ৫৮ হাজার ৯৪৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।

২০১৫ সালের আয়কর আইনের এসআরও নং ১৫৮ অনুযায়ী, পিডিবি একটি জনসেবা কাজে নিয়োজিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আয়কর হার ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রির ফলে প্রতি বছর পিডিবির বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৮২সি(৪) ধারা অনুসারে এ ধরনের লোকসানি প্রতিষ্ঠানের জন্য ন্যূনতম করের হার সর্বমোট প্রাপ্তির ০.৬০ শতাংশ। তবে অর্থ আইন ২০২১-এর মাধ্যমে ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশের প্রতিস্থাপিত ধারা ৫২এন-এর বিধান অনুযায়ী তা ছয় শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে নির্ধারিত হারের ১০ গুণ অর্থ কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে পিডিবির লোকসান আরও বৃদ্ধি পাবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর সাথে পিডিবির ‘কস্ট বেজ’ বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যয়ের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জ্বালানি ব্যয়। আর কোম্পানিগুলো জ্বালানি মূল্য পরিশোধের সময় ভ্যাট/ট্যাক্স পরিশোধ করে থাকে। অবশিষ্ট ১০ থেকে ২০ শতাংশ ব্যয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রকল্প ব্যয়ের ঋণ (সুদ ও আসল) পরিশোধ এবং পরিচালন ও মেরামতে ব্যয়ে যায়। ফলে অর্থ আইন ২০২১-এর ৫২এন ধারার জন্য পিডিবি ও রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদন কোম্পানিগুলো ভীষণভাবে আর্থিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। এছাড়া এ ধারার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে জ্বালানি আমদানির ওপর অগ্রিম আয়কর পরিশোধ সত্ত্বেও আবার বিক্রয়মূল্যের ওপর ছয় শতাংশ কর পরিশোধ করতে হচ্ছে।

যদিও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আওতাধীন তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে বিতরণ কোম্পানিগুলোর ওপর ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ৫২-এর ১৬ বিধান অনুসারে, উৎসে কর হার ০.৬০ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। একইভাবে পিডিবির আওতাধীন সরকারি কোম্পানিগুলোর বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে উৎসে কর ০.৬০ শতাংশ নির্ধারণ করা সমীচীন হবে। এছাড়া বিইআরসির সর্বশেষ নির্ধারিত ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির আদেশ এখনও বিদ্যমান রয়েছে। এতে অর্থ আইন ২০২১-এর ৫২এন ধারা সংশোধন করে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে প্রযোজ্য উৎসে কর ছয় শতাংশ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা যেতে পারে।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বিপিসি ও তার আওতাধীন কোম্পানিগুলো মুনাফায় রয়েছে। অথচ তাদের উৎসে কর ০.৬০ শতাংশ। আর পিডিবি লোকসানি হওয়ার পরও তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি (ছয় শতাংশ) উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। এতে পিডিবির লোকসান বাড়বে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। তাই অর্থ আইন ২০২১-এর ৫২এন ধারা সংশোধন করে পিডিবির ওপর ০.৬০ শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগকেও বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার জন্য বলা হয়েছে। আশা করা যায়, এনবিআর বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০