Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 10:15 pm

লোকসানে থাকলেও সমন্বয়ের চিঠিতে আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা

আতাউর রহমান: দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে দুটি বড় ধস দেখা গেছে। এর একটি ১৯৯৬ এবং অপরটি ২০১০ সালে। ’৯৬-এর চেয়ে ২০১০ সালের ধসটি বড় ছিল বলে জানান বাজার বিশেষজ্ঞরা। ২০১০ সালে যে ধস হয় তার অন্যতম কারণ ছিল মার্জিন ঋণ। সে সময় গ্রাহককে ধরে রাখার জন্য অনিচ্ছা এবং নিয়মের বাইরে গিয়েও অনেক ব্রোকারেজ হাউসে মার্জিন ঋণ দিতে দেখা গেছে। ফলে বাজার বড় ধসের সম্মুখীন হয়। কিন্তু সে সময় মার্জিণ ঋণ নিয়ে কেনা শেয়ারে এখন পর্যন্ত কেউ মুনাফার মুখ দেখেননি। গ্রাহকের বিও হিসাব লোকসানে থাকলেও তা সমন্বয়ে দেয়া হচ্ছে চিঠি। নির্দিষ্ট সময়ে সমন্বয় না করা হলে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার নামে ভয় দেখানো হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের। ফলে অনেকে আতঙ্কে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন এবং নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণে এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা ও স্বার্থ নিশ্চিতের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে। যেসব বিনিয়োগকারী লোকসানে রয়েছেন, তাদের কেন মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে চিঠি ও ভয় দেখানো হচ্ছে সেটা অবশ্যই বিএসইসির নজরে আনা জরুরি। সেই সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান চিঠি দিচ্ছে তারা কি বিএসইসির নির্দেশনা পালনে এ কাজ করছে, না কি বাজারে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে সে বিষয়েও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

তথ্য মতে, সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে বিনিয়োগকারীদের। তারা ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত লোকসানে থাকা বিনিয়োকারীদেরও এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও মার্চেন্ট ব্যাংক আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালে মার্জিন ঋণ নেয়া বিও হিসাবগুলোকে ঋণ সমন্বয়ের বিষয়ে চিঠি দিয়েছে। এর মধ্যে এমন বিও হিসাব রয়েছে, যেগুলোয় সে সময়ের পর থেকে আর লেনদেন পরিচালনা করা হয়নি। দেখা যায়, সেসব বিও হিসাবের বেশিরভাগ ৯০ শতাংশের বেশি লোকসানে রয়েছে। কিন্তু তাদের মার্জিন ঋণ সমন্বয়ের জন্য মাত্র ১৫ দিন সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে; যা বিও হিসাবে লেনদেন পরিচালনা না করেও দায় সমন্বয়ে বিনিয়োগকারীকে সংকটে ফেলেছে।

যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১০ সালের মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে সেগুলোয় দেখা যায়, নাম না প্রকাশের শর্তে এক বিনিয়োগকারী শেয়ার বিজকে জানান, ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে আমার মূল বিনিয়োগ ছিল ১০ লাখ টাকা। সে সময় মার্জিণ ঋণ নিয়ে আরও ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। পরে বাজার ধসে আমার সে বিনিয়োগ পাঁচ লাখ টাকায় নেমে আসে। এরপর সেই হিসাবে এখন পর্যন্ত লেনদেন করিনি। কিন্তু গত কয়েক বছরে আমার সেই বিনিয়োগ নেমে এসেছে দুই লাখ টাকায়। এখন হাউস মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে কয়েকবার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু আমি এ টাকা কোথা থেকে দেব। তাদের বলেছি, শেয়ারের দাম বাড়লে বিক্রি করে টাকা নিতে। না হলে যা আছে বিক্রি করে হিসাব বন্ধ করে দিতে। তবে তারা মানতে চান না। তারা বলছেন, শেয়ার বিক্রি করে যে টাকা বাকি থাকবে তা আমাকে দিতে হবে। এটা তো অন্যায় ও জুলুম করা হচ্ছে।

অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন, সঞ্চয়ের ৮ লাখ টাকা সে সময় বিনিয়োগ করেছিলাম। দুই বছরে লাভসহ বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১৫ লাখ টাকা। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু মার্জিন ঋণের ফাঁদে পড়ে এখন সব হারিয়েছি। দুই দফা ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এখন বিপদে আছি। সে সময় পতনে বিনিয়োগের ৩৫ লাখ টাকা কমে দাঁড়ায় ১০ লাখ টাকায়। পরে শেয়ার দর কমা ও বৃদ্ধির মাধ্যমে এখন ১৫ লাখ টাকা হয়েছে। এখন শেয়ার বিক্রি করে এ টাকা দেয়ার পরও আরও পাঁচ লাখ টাকা হাউসকে দিতে হবে। তাহলে আমার বিনিয়োগ তো সব গেল, সেই সঙ্গে পকেট থেকেও এখন টাকা দিতে হবে, যা আমার কাছে নেই। হাউস থেকে বেশি চাপাচাপি করলে আত্মহত্যা ছাড়া আর পথ থাকবে না।

মার্জিন ঋণের কারণে আত্মহত্যা করা লাগবে বলে আরেক বিনিয়োগকারী জানান, ২০১০ সালে শেয়ারের দাম প্রথমে বাড়তে দেখে লোভে পড়ে বিনিয়োগ করেন ২০ লাখ টাকা। পরে আরও লোভ করে ৩০ লাখ টাকা মার্জিণ ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন তিনি। কিন্তু সেই বিনিয়োগ আর কাজে আসেনি তার। পতনের পর তার বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১৮ লাখ টাকায়। গত কয়েক বছরেও সেই টাকা আর বাড়েনি। বরং নানা সময় শেয়ারের দাম কমার মাধ্যমে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ টাকায়। এখন বারবার হাউস থেকে মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে চিঠি দেয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন তিনি। কোনো রকম একটি চাকরির বেতনের টাকা দিয়ে চলছে তার সংসার। কিন্তু এ মুহূর্তে মার্জিন ঋণের চাপে তার আত্মহত্যার কথা মাথায় এসেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

তথ্য মতে, এমন আরও লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই সঞ্চয়ের সমপরিমাণ মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। এরপর যখন দরপতন শুরু হয়, ব্রোকাররা নিজেদের টাকা তুলে নিতে মার্জিন অ্যাকাউন্টের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সড সেল) করে দেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়, ধস নামে বাজারে।

এদিকে ডিএসই ও বিএসইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৩৩ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্সধারী (বিও) বিনিয়োগকারীর মধ্যে মার্জিন ঋণ নেয়াদের নেগেটিভ ইকুইটি ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। একের পর এক সুবিধা দিয়ে যা গত ১২ বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা কমে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউসগুলো এখনও সেই লসের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে যখনই দরপতন হয়, তখনই এ মার্জিন ঋণ দেয়া ব্রোকার হাউসগুলো শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুল নেয়। এতে দরপতন বিলম্বিত হয়। বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত পুঁজি হারান।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে মার্জিন ঋণ পরিহার করা উচিত। তাহলে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়বে, কমবে কারসাজি। ২০১০ সালের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও পুঁজিবাজারে ধসের পেছনে মার্জিন ঋণকে দায়ী করা হয়। সেখানে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ পরিহারের সুপারিশও করা হয়।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সিকিউরিটিজের ট্রেডার বলেন, ২০০৯-১০ সালের দিকে মার্জিন ঋণ না দিলে হাউসে বিনিয়োগকারীরা থাকত না। অন্য হাউসে চলে যেত। চাকরি বাঁচানোর জন্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে সে সময় মার্জিন ঋণ দিতে হয়েছে। মার্জিন ঋণ নিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী মুনাফা করেছেন। সেই মুনাফা তুলে যারা অন্য খাতে ব্যয় করেছেন তারাই গেইন হয়েছেন। কিন্তু যারা মার্কেটেই বিনিয়োগ করেছেন, তারা নিঃস্ব হয়েছেন।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, কমিশন থেকে মার্জিন ঋণের নেগেটিভ ইকুইটি সমন্বয়ে যে সময় বৃদ্ধি করা হয়েছিল সেটা শেষ হয়ে গেছে। তাই ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে তাদের নেগেটিভ ইকুইটি নির্দিষ্ট সময়ে সমন্বয় করতে হবে। সেক্ষেত্রে নেগেটিভ ইকুইটির বিপরীতে যে প্রভিশন রাখা আছে সেটার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু সমন্বয় করবে। যাতে বাজারে ফোর্সড সেল না আসে এবং বিনিয়োগকারীরা পেনিক না হয়। বাকিটা গ্রাহকের স্বার্থ ঠিক রেখে এবং তাদের আতঙ্কিত না করে বাস্তবায়ন করবে প্রতিষ্ঠান।

বড় ধরনের ঘাটতি থাকায় মার্জিন ঋণ সমন্বয়ে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে রয়েছেন সেক্ষেত্রে তারা কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রাহকের সঙ্গে মার্জিন ঋণের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী কাজ করবে। সেক্ষেত্রে মার্জিন ঋণের নেগেটিভ ইকুইটি কোনো পর্যায়ে গেলে কীভাবে সমন্বয় করা হবে সেটা চুক্তিতে বলা আছে। সাধারণত গ্রাহকের নেগেটিভ ইকুইটি অস্বাভাবিক হওয়ার কথা না। তবে প্রতিষ্ঠান যদি অতিরিক্ত পরিমাণে ঋণ দিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে ঋণের সুদ ও সার্ভিস চার্জ হিসাব করে সেটা সমন্বয় করবে। আর বাজারে যাতে কোনো ফোর্সড সেল না হয় এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ নিশ্চিত করে তারা যেন পেনিক না হয় সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো খেয়াল রাখবে বলে তিনি প্রত্যাশা করেন।