লড়ো, নয়তো ভাগো নিজের অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন

বিপদ-আপদের বিরুদ্ধে আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আত্মরক্ষা করে, যাকে আমরা ‘স্ট্রেস’ বলি। এই আত্মরক্ষার বৈশিষ্ট্যটি জন্ম গত। বিপদ-আপদ বা স্ট্রেসের আগমনে আমাদের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম ও এন্ডোক্রাইন গ্লান্ড সম্মিলিতভাবে দেহকে এমনভাবে প্রস্তুত করে যেন দেহ বিপদসংকুল পরিস্থিতি থেকে হয় পালিয়ে যেতে পারে, নয়তো বাঁচার জন্য লড়তে পারে। প্রতিপক্ষ বিপদকে কাবু করার জন্য শরীরের এই বিশেষ প্রতিক্রিয়াকে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ বলা হয়, বাংলায় ‘লড়ো নয়তো ভাগো’ বলা যেতে পারে।
আসুন বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য মনে মনে একটি দৃশ্য কল্পনা করি। ধরুন বন্ধুর আমন্ত্রণে গিয়েছেন রাতের সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আপনাদের নৌকায় কোনো কিছুরই কমতি ছিল না, তাই তীর থেকে একটু দূরে যেতে ভয় পাননি। রয়েল বেঙ্গল টাইগার সাঁতরে আর কতদূরই বা আসতে পারবে। তাই ভয়হীন চিত্তে বসে গেলেন গানের আড্ডায়। সবে আপনার বন্ধু গিটারে সুর ধরেছেন, এমন সময় দেখতে পেলেন ইয়া বড় এক কিং কোবরা গানের টানে চলে এসেছে। ঠিক যেই মুহূর্তে আপনি কোবরাকে দেখতে পেলেন তখন আপনার ব্রেইন কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাবে যাতে আপনার শরীর আসন্ন বিপদ থেকে বেঁচে ফিরতে পারে। পরিবর্তনগুলো এমন

হুৎকম্পন ও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, যাতে শরীরের প্রান্তীয় কোষগুলোতেও রক্ত সরবরাহ করতে পারে

চোখের মণি বড় হওয়া যাতে বেশি আলো প্রবেশ করতে পারে

ত্বকের শিরাগুলো সংকুচিত হয়ে আসে, যেন বিপদের সময় ত্বক অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পেশিগুলোতে রক্তের সরবরাহ বাড়ে। এ কারণে এ সময় শীতশীত অনুভূত হয়, কারণ তখন ত্বককে উষ্ণ রাখার জন্য যথেষ্ট রক্ত ত্বকে থাকে না। অনেক সময় ভয় পেলে আমাদের এমন অনুভূতি হয়

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, যেন বাড়তি শক্তি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে

অ্যাড্রিনালিন ও গ্লুকোজের ক্রিয়ায় পেশি শক্তিশালী ও টানটান হয়। ফলে গুজবাম্প দেখতে পাই, যাকে বাংলায় শরীরে কাঁটা দেওয়া বলা হয়। কারণ এ সময় ত্বকের লোমের চারপাশের পেশিগুলো টানটান হয়ে আশপাশের ত্বকসহ ওপরে ফুলে ওঠে

ফুসফুসের ক্ষুদ্র পেশিগুলো শিথিল হয়, অধিক অক্সিজেন দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে

বিপদের মুহূর্তে অপেক্ষাকৃত অত্যাবশ্যকীয় সিস্টেমগুলো (পাচনতন্ত্র, রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা) বন্ধ হয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জরুরি কাজে শক্তি সরবরাহ করে

মস্তিষ্ক তখন ছোটখাটো বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারে না, কেননা তখন এটি স্ট্রেসের (এখানে কোবরা) মোকাবিলাতে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়।
এই সামগ্রিক পরিবর্তনটাই আসলে লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়া। এখন এই প্রতিক্রিয়া থেকে সুফল পেয়ে আপনাদের কেউ কেউ নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কূলে ফিরতে সমর্থ হলেন,
দু-একজন আবার উদ্যোগী হয়ে কোবরার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন এবং অবশেষে আপনারা জয়ী হলেন। এবার জীবনগ্রাসী বিপদ থেকে বেঁচে ফিরতে পেরে নিজেকে ভীষণ শ্রান্ত এবং পরিশ্রান্ত অনুভব করতে থাকলেন। এ সময় ঘুমিয়ে পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়। শরীরের এমন উত্তেজিত হওয়া থেকে প্রশান্ত হওয়া পর্যন্ত সব কাজই কিন্তু দেহাভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া কিছু কেমিক্যাল বিক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়। এই কেমিক্যাল বিক্রিয়াগুলোকে সামগ্রিকভাবে লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়া বলা হয়। সে যাই হোক একটি বিষয় কিন্তু খুব পরিষ্কার, তা হলো এই লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি বিপদে জীবন রক্ষায় অনস্বীকার্য। একটু ভাবুন তো যদি বিপদের মুহূর্তে আপনার দেহে ওই পরিবর্তনগুলো না হতো তাহলে তো কোবরার হাত থেকে নিস্তার ছিল না।
আসুন, এবার দেখি লড়ো নয়তো ভাগো উৎপন্ন করতে শরীর কীভাবে কাজ করে। যখন কেউ স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিতে পড়ে তখন মস্তিষ্কের আমিগডালা নামক স্থান, যেখানে মূলত আবেগ প্রসেস হয়, সেখান থেকে হাইপোথ্যালামাসে একটা সিগন্যাল যায়। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস মূলত কমান্ড সেন্টার হিসেবে কাজ করে। হাইপোথ্যালামাস দুটি সিস্টেমকে অ্যাক্টিভেট করে, যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি শুরু হয়ে একপর্যায়ে শেষ হয়। এদের একটি হচ্ছে সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম, যা স্নায়ুর মধ্য দিয়ে কাজ করে। যখন এই সিস্টেমটি হাইপোথ্যালামাস থেকে সিগন্যাল পায় তখন এটি শরীরকে সার্বিকভাবে অ্যালার্ট করে যার প্রভাবে শরীরের সার্বিক গতি বেড়ে যায়, শরীর শক্ত হয়ে ওঠে, ঠিক নৈাকায় কোবরাকে দেখামাত্র শরীর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে তেমন। এ সময় সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম বিভিন্ন গ্ল্যান্ড ও নরম মাংসপেশিকে বার্তা পাঠায় যাতে তারা নিজ কাজে নেমে পড়ে এবং এড্রিনাল মেডুলাকে বলে এপিনঅ্যাফরিন ও নর-এপিনঅ্যাফরিন হরমোন দুটি রক্তস্রোতে অবমুক্ত করতে। এই দুটি স্ট্রেস হরমোন হৃৎকম্পন ও রক্তচাপ বৃদ্ধিসহ শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে। একই সঙ্গে হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি গ্ল্যান্ডকে অ্যাকটিভ করার মধ্য দিয়ে অ্যাড্রিনাল-কর্টিকাল নামে আরও একটি সিস্টেমকে অ্যাকটিভ করে, যা রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে কাজ করে। ফলে অ্যাড্রন্যাল কর্টেক্স থেকে কর্টিসলসহ ৩০টি ভিন্ন ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যারা লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি সৃষ্টিতে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। এই শারীরিক প্রতিক্রিয়াটির লক্ষ্য কিন্তু একটা, আর তা হলো বিপদের মুহূর্তে টিকে থাকা। অর্থাৎ হয় দৌড়ে পালানোর জন্য নয়তো বিপদের সঙ্গে লড়ার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করা। তবে বিপদ যখন তিরোহিত, অর্থাৎ কোবরাকে একবার যখন আপনারা পরাজিত করলেন তখন হাইপোথ্যালামাসের নির্দেশে সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম কাজ বন্ধ করে দেয় আর প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম হঠাৎ গর্জে ওঠা শরীরটাকে আস্তে আস্তে প্রশমিত করে।
সমস্যা হচ্ছে এই অত্যন্ত উপকারী শারীরিক একটি প্রতিক্রিয়া শরীরের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণও হতে পারে। আমরা জানলাম যে স্ট্রেসের (যেমন কোবরা) উপস্থিতিতে শরীর লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি সৃষ্টি করে। সাধারণভাবে অস্তিত্বের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়কেই মস্তিষ্ক স্ট্রেস হিসেবে গণ্য করে। তবে কখনও কখনও খুবই কাক্সিক্ষত বা আনন্দের বিষয়গুলোও স্ট্রেসের কারণ হতে পারে, যেমন সন্তান ধারণ, ভ্রমণে যাওয়া, নতুন বাসায় ওঠা, পদোন্নতি প্রভৃতি। কেননা এ সময় আমরা বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্মুখীন হই, যার জন্য প্রয়োজন পড়ে বাড়তি প্রচেষ্টা এবং নতুন দায়িত্ব ও পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সক্ষমতা। তাই আমরা আতঙ্কিত হই বিষয়টি নিয়ে, আর তখনই মস্তিষ্ক একে স্ট্রেস মনে করে স্ট্রেস প্রতিক্রিয়া শুরু করে।
একেক মানুষ স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। একজনের জন্য যা স্ট্রেসফুল, তা অন্যজনের জন্য নাও হতে পারে। যেমন একজন বাগ্মীকে বিনা নোটিসে মঞ্চে তুলে দিলে তিনি এতটুকু স্ট্রেসড না হয়ে কর্ম সম্পাদন করে আসতে পারেন, কিন্তু সেই একই কাজ যদি একজন লাজুক মানুষকে করতে বলা হয় তবে তিনি হয়তো ঘেমেনেয়ে একাকার হতে পারেন, কারণ তিনি তখন স্ট্রেসড হয়ে পড়েন। আর কিছু মানুষ আছেন, যাদের জন্য বিশেষ কোনো একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করাটাও স্ট্রেসফুল।
তবে সাধারণত বেশিরভাগ মানুষই যেসব বিষয়ে স্ট্রেসড বোধ করেন সেগুলো হলো:
চাকরি বা চাকরি থেকে অবসর নেওয়া সম্পর্কিত
সময় বা অর্থের অভাব
কাছের মানুষের মুত্যু
পারিবারিক সমস্যা
শারীরিক অসুস্থতা
বাসস্থান পরিবর্তন
বিবাহবন্ধন বা বিবাহবিচ্ছেদ প্রভৃতি।
আরও রয়েছে অ্যাবরশন বা মিসক্যারিজ, রোড অ্যাক্সিডেন্টের ভয়, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝামেলা, গর্ভধারণ বা নতুন বাবা-মা হওয়া, অতিরিক্ত শব্দ বা জনসমাগম বা অন্য দূষণ, কোনো কাক্সিক্ষত ফল বা দিনের জন্য অপেক্ষা করা প্রভৃতি।
উপরোক্ত তথ্যগুলো থেকে বলতে পারি, আপনি সারা দিনই হয়তো কোবরাবেষ্টিত, কেননা আপনার বস কোবরা, রাস্তার জ্যাম কোবরা, কাজের ডেডলাইন কোবরা এমনকি ভ্রমণে যাওয়ার মতো আনন্দের বিষয়ও হয়তো আপনার জন্য কোবরা। এভাবে প্রতিনিয়ত কোবরা দ্বারা বেষ্টিত থাকলে আপনার লড়ো নয়তো ভাগো প্রতিক্রিয়াটি আর প্রশমিত হবে না। আপনার হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, রক্তের গ্লুকোজ সবসময় উঁচুতে থাকবে। অর্থাৎ আপনার রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, হার্ট-অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে, ওবেসিটি কিংবা ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে। আর হ্যাঁ আপনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যেতে পারে। ২০১২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, যেসব বাবা-মা উপর্যুপরি স্ট্রেসের মুখোমুখি হয়েছেন হতে পারে তা অর্থনৈতিক বা সামাজিক বা পারিবারিক কোনো সমস্যা, তাদের ছেলেমেয়েরা ওবেসিটিতে বেশি ভোগেন। অর্থাৎ শুধু আপনি নন, আপনার সন্তানও আপনার স্ট্রেসের বলি হতে পারে। স্বস্তির বিষয়, চাইলেই আমরা স্ট্রেসকে ম্যানেজ করতে পারি এবং অনেকেই তা করি। কেউ হয়তো শারীরিক কসরত করি, কেউ নিয়মিত প্রার্থনা করি, কেউ ভালো বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই, কেউ ইয়োগা করি কেউবা আবার গভীর শ্বাস নেওয়ার অনুশীলন করি।

জুঁই ইয়াসমিন, পুষ্টিবিজ্ঞান প্রশিক্ষক

 

 

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০