বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘এক্সপ্লোরিং মার্জার অ্যান্ড অ্যাকুইজেশন ইন দ্য কনটেক্সট অব দ্য ব্যাংকিং সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মশালাটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল নানা কারণে। সেখানে উপস্থিত বক্তারা একদিকে যেমন আলোচনা করেছেন সাম্প্র্রতিক সময়ে আলোচিত খেলাপি ঋণ নিয়ে, তেমনি ভবিষ্যতে কোম্পানি মার্জারের বেলায় গাইডলাইন কেমন হওয়া উচিতÑসেটিও উঠে এসেছে তাদের বক্তব্যে। সেসবের বিস্তারিত নিয়ে গতকালের শেয়ার বিজে ছাপা খবরটি অনেক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে।
কর্মশালায় যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার কোনো একটি ইস্যুকে খাটো না করেও বলা যায়, এর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা ঘিরে খোদ ব্যাংকারদের মূল্যায়ন। তাতে দেখা যায়, দেশের ৭২ শতাংশ ব্যাংক কর্মকর্তাই মনে করেন এক. স্থানীয় ব্যাংকের বর্তমান সংখ্যা কমাতে হবে এবং দুই. সরকার আর্থিক খাতকে রাজনীতির বাইরে রাখতে সক্ষম হলে ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ সমস্যারই সমাধান হবে, যার মধ্যে খেলাপি ঋণ অন্যতম। তাদের মতে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে এখন বলা যায় ব্যাংকগুলো মুদির দোকানে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনে একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ চারজন পরিচালক থাকার বিধান চালু হলে এ পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে বাধ্য। প্রথম বিষয় হলো, আপাতদৃষ্টিতে কথাগুলো যেমনই শোনাক মতগুলো ব্যাংক খাতের ভেতরকার মানুষদেরই মনোভাবের প্রতিফলন। তারা অনুভব করেন, দেশে এত বেশি ব্যাংক হওয়ার প্রয়োজন ছিল না এবং মালিক কর্তৃক কিংবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মাঝেমধ্যেই পেশাদার ব্যাংকিং অনুশীলনে ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। এ অবস্থায় বিআইবিএম কর্মশালায় উত্থাপিত বিশেষজ্ঞ মতামত যথাযোগ্যভাবে আমলে নেওয়াটা জরুরি মনে হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে নতুন ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন প্রদানের প্রসঙ্গ যখন আলোচনায় চলে আসে, তখন থেকেই অনেক বিশেষজ্ঞ বলছিলেন এত ব্যাংক আমাদের দরকার নেই। কেন সেগুলো দরকার নেই, তা বোঝাতে গিয়ে ‘নতুন ব্যাংকগুলো আর্থিক খাতকে ঝামেলায় ফেলবে’ এমন যুক্তি দেখান কেউ কেউ। বাহ্যত এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে এর একটা প্রভাব যে পড়বে, সেটা ধরে নেওয়াই ছিল সংগত এবং নতুন ব্যাংকগুলোর প্রতি ব্যাংকারদের অমন মন্তব্য ওই প্রভাবেরই প্রতিফলন বলে প্রতীয়মান। এখন নীতিনির্ধারকদের খতিয়ে দেখা উচিত, আর্থিক খাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে কি না। যদি সেটাই হয়, তাহলে সময়োচিত মার্জার বা অ্যাকুইজেশন পরিস্থিতি আদৌ সামলাতে পারবে কি? দ্বিতীয় ইস্যু হলো, ব্যাংকিং কার্যক্রমকে অবিবেচনাপ্রসূত বা ক্ষতিকর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে রাখা। এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। অস্বীকার করা যাবে না, একটি দেশের অর্থনীতির অপরিহার্য ও শক্তিশালী উপাদান হচ্ছে ব্যাংক। আবার ব্যাংক খাতের ওপর ক্ষতিকর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রভাব কেমন হতে পারে, তার উদাহরণ আমাদের সামনেই রেখেছে সাম্প্রতিক বিশ্ব। দুর্ভাগ্যজনক, সেসব শিক্ষার খুব কমই সদ্ব্যবহার করেছি আমরা। ব্যাংক খাতের বড় রকম ঝুঁকি হ্রাসে ওই সংস্কৃতি থেকে দ্রুত বেরোনো প্রয়োজন। আমাদের ব্যাংক খাত অর্থনীতির উন্নয়নে অব্যাহতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, এ মন্তব্য বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তর্কসাপেক্ষ হলো, এর যতটুকু অবদান রাখার কথা ছিল, ততটুকু পারছে কি না এবং এখন পর্যন্ত যতটুকু অবদান রেখেছে, সেখানে ন্যায্যতার মতো উপাদান কী মাত্রায় বজায় ছিল। লক্ষণীয়, এখনও একশ্রেণির বৃহৎ ঋণগ্রহীতা মন্দ খেলাপি ঋণের চর্চা করে যাচ্ছেন এবং তার বিপরীতে আরেক দল মধ্যম ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ী জুতার তলা খুইয়েও পাচ্ছেন না ঋণ। ব্যাংক খাতের ওপর থেকে যদি অশুভ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অপসৃত না হয়, তাহলে এ চিত্রে তেমন পরিবর্তন আসবে না বলেই সবার ধারণা। এক্ষেত্রে তাই সরকারেরই উচিত শক্ত অবস্থান নেওয়া।