শখে সফল শাহনাজ

বগুড়ার মেয়ে শাহনাজ ইসলাম শিল্পী। শহরজুড়ে এখন পরিচিত ‘শিল্পী আপা’ নামে। শৈশব কেটেছে বগুড়া শহরে। বাবা একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ছিলেন। পড়াশোনা শেষে চাকরি করবেন সেটাই ছিল কথা। কিন্তু নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে হয় তার। স্বামী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলী। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় বদলি হয়ে যেতেন।
স্বামীর ঘরে গিয়েও দমলেন না শাহনাজ। ঘরেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। চাকরিজীবী স্বামী সারাদিন বাইরে থাকতেন। সময় কাটাতে সেলাই আর রান্নার শখে ডুবে গেলেন। ঘরে বসে পড়াশোনা, নতুন নতুন রান্না আর নিজের হাতে হরেক ডিজাইনের সালোয়ার-কামিজ সেলাই করতে লাগলেন। বাজার থেকে শাড়ি কিনে তাতে হাতের কাজ করতে লাগলেন। নিজের কাজ করা পোশাক পরার পর লোকজন প্রশংসা করতেন। সরকারি কোয়ার্টারে থাকতে গিয়ে অন্যান্য নারীর সঙ্গেও ভাব জমে যেত। ওই নারীদের নিয়ে প্রায়ই রান্নার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। শখ নিয়ে সময় কাটানো থেকেই এখন সফল একজন উদ্যোক্তা তিনি।
বর্তমানে বগুড়া শহরের অভিজাত এলাকা জলেশ্বরীতলায় বুটিক শপ, ফ্যাশন হাউজ ও চায়নিজ রেস্টুরেন্টের কর্ণধার শাহনাজ। নাম দিয়েছেন ‘শখ’। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশ নামডাক শহরজুড়ে। একসঙ্গে সংসার ও ব্যবসা সামলে শুধু সফলই হননি তিনি, ব্যবসার আয়ে এক সন্তানকে পড়াশোনার জন্য বিদেশেও পাঠিয়েছেন। অন্য দুই সন্তানকে পড়াচ্ছেন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। একজন সফল নারী হিসেবে শহরজুড়ে এখন অনেক পরিচিতি তার।
শখ থেকে সফল নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প বলেছেন শাহনাজ: পড়াশোনার শখ ছিল। দুই সন্তান কোলে নিয়ে ১৯৯২ সালে এইচএসসি পাস করি। হাতের কাজের শখ ছিল। ১৯৯৫ সালে ঢাকায় এক আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গেছি। তিনি বুটিক হাউজের উদ্যোক্তা ছিলেন। ওই বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় বুটিকের স্টল দিয়েছিলাম। হাতের কাজের আগ্রহ দেখে আমাকে ২০টি শাড়ির অর্ডার দিলেন। রাতেই দোকান থেকে শাড়ি কিনে কয়েক দিন ধরে তাতে হাতের কাজ করলাম। ৮০০ টাকা করে আমার কাছ থেকে শাড়ি কিনে সেই আত্মীয় ওই শাড়িমেলায় ২০০০ টাকায় বিক্রি করলেন। চোখ খুলে গেল আমার। মাথায় এলো শখের এই কাজ করে আমিও ঘরে বসে বাড়তি আয় করতে পারি। এরপর বগুড়ায় ফিরে মালতিনগরের বাসায় ১৫ হাজার টাকার পুঁজিতে বুটিক হাউজ খুলে বসলাম। ভালো সাড়া পেলাম। পরিবার থেকেও উৎসাহ মিলল।
শিল্পী বলেন, এক বছরের মাথায় জলেশ্বরীতলায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে ‘শখ’ বুটিক শপ খুলি। নিজেই ডিজাইন করতাম। কারিগররা বাড়িতে কাজ করতেন। অল্পদিনেই শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল শখ-এর পরিচিতি। তখন বগুড়া শহরের নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তিনি আরও বলেন, নিজেই কাঁচামাল কিনতাম। নিজেই ব্যাংকের সব কাজ সামলাতাম। পাইকারি অর্ডার নিতাম। একজন নারী হয়ে দোকানে বসে ক্রেতা সামলানোর বিষয়টি তখন অনেকে ভালো চোখে দেখেননি। কিন্তু স্বামী শফিকুল ইসলাম ব্যবসায় উৎসাহ দিতেন। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ব্লক, বাটিক ও নকশার কাজ করা সালোয়ার-কামিজ, থ্রিপিস, শাড়ি, বিছানার চাদর, কুশন কভার, শাল-চাদরের ব্যাপক চাহিদা বাড়তে লাগল।
২০০১ সালে স্বামী মারা যাওয়ায় কিছুটা ভেঙে পড়েন। এখন তার দোকানে ৮০ লাখ টাকার পুঁজি খাটছে। শখে সালোয়ার-কামিজ এক হাজার ৬০০ থেকে তিন হাজার ২০০, শাড়ি এক হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৮০০, বেডকভার এক হাজার ৮০০ থেকে পাঁচ হাজার, শাল-চাদর ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার, কুশন কভার ২০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শিল্পীর সাফল্যের গল্প এখানেই শেষ নয়। বড় ছেলেকে পড়াশোনার জন্য কানাডা পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি ওখানকার একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করে ছেলেটা। ওর পরামর্শে এক বছর আগে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে ‘শখ’ নামে একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্ট চালু করেছি। পোশাক ও খাবারকে বিশ্বজুড়ে তুলে ধরাটাই এখন আমার বড় শখ।

পারভীন লুনা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০