নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: উচ্চ শুল্কের পণ্য কম শুল্কে ছাড় নিতে অসৎ ব্যবসায়ীরা নানা রকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন। এর মধ্যে মিথ্যা ঘোষণার পাশাপাশি ঘোষিত পণ্যের আড়ালে অঘোষিত পণ্য নিয়ে আসা হয়। তবে কিছু চালান নিতে পারলেও বেশিরভাগ মিথ্যা ঘোষণার চালান আটক হয় কাস্টমস কর্তাদের হাতে। তেমনই গত এক সপ্তাহে দুটি চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, যার বিপরীতে রাজস্ব ফাঁকি হতে পারত প্রায় শতকোটি টাকা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রে জানা যায়, গত পরশু চীন থেকে আর্ট পেপার ঘোষণায় আসা ২০ ফুট লম্বা এক কনটেইনারে তিন কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজারটি সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প আটক করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এই চালানের মাধ্যমে সরকারের প্রায় ৯০ থেকে ১৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব হারানোর আশঙ্কা ছিল। কিন্তু কাস্টমস কর্মকর্তাদের তৎপরতায় শেষ রক্ষা হয়নি আমদানিকারকের।
জানা যায়, চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লার আমদানিকারক বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামে এক প্রতিষ্ঠান চীন থেকে আর্ট পেপার ঘোষণায় এই পণ্য আমদানি করে, যেটি খালাসের জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রামের মধুমতি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড নামের অন্য এক প্রতিষ্ঠান, যারা গত ৯ ডিসেম্বর পণ্য চালানটি খালাসের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ) ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় রপ্তানিকারক, রপ্তানিকারকের ওয়েবসাইট, পণ্য তৈরির দেশ, আমদানিকারকের ব্যবসায়ের ধরন ও ঠিকানা, পণ্যের বর্ণনা প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে পণ্যচালানটিতে অসত্য ঘোষণায় সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারযোগ্য জাল স্ট্যাম্প থাকার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে।
পরে অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) টিম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে পণ্যচালানের বিল অব এন্ট্রিটি লক করে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার পণ্যচালানের কনটেইনার নামিয়ে বন্দরের অভ্যন্তরে কায়িক পরীক্ষা করলে কনটেইনারের ২০টি প্যালেটের মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে পাঁচটি প্যালেট দেখানোর পর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট গড়িমসি শুরু করে এবং একপর্যায়ে কায়িক পরীক্ষা শেষ করারও অনুরোধ করে। কারণ ওই পাঁচটি প্যালেটেই শুধুই আর্ট পেপার ছিল। আর বাকি প্যালেটগুলোয় সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প লুকানো ছিল।
অতঃপর এআইআর টিম ২০টি প্যালেট শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করলে ২৪৬ প্যাকেটে (প্রতি প্যাকেটে ২৬০ বান্ডিল এবং প্রতি বান্ডিলে ৫০০ পিস হিসেবে) তিন কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজারটি নি¤œস্তরের ১০ শলাকাবিশিষ্ট সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারের উপযোগী হালকা খয়েরি রংয়ের জাল স্ট্যাম্প পাওয়া যায়, যার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৯ টাকা থেকে ৬২ টাকা এবং এর বিপরীতে সম্পূরক শুল্কের হার ৫৭ শতাংশ এবং মূসকের হার ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ এ-জাতীয় পণ্য দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করার কোনো সুযোগ নেই। অথচ বড় অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিতে আমদানিকারক এমন পন্থা অবলম্বন করে।
এর আগে গত ৯ ডিসেম্বর ১০০ ভাগ পলিস্টার সুতা ঘোষণার আনা ৯ হাজার ৮৫৫ কেজি কেমিক্যালের অপর একটি চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। ওই চালানটি ময়মনসিংহের ভালুকা পৌরসভার পিএনআর ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের নামের এক প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধায় আমদানি করে। যদিও আমদানিকারকের ঘোষণা ছিল ১০০ শতাংশ পলিস্টার ইয়ার্ন, যার নিট ওজন ২৫ টন এবং আমদানিমূল্য দেখানো হয়েছিল ৪১ হাজার ৫৬০ ইউএস ডলার, বা ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭১ টাকা।
চালানটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট চট্টগ্রাম আগ্রাবাদের রাসেল গার্মেন্ট গত ৬ ডিসেম্বর কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। কিন্তু কাস্টম হাউসের এআইআর শাখা খালাসকালে কনটেইনারের সামনে উপস্থিত হয়ে প্রাথমিকভাবে ওই চালানে সুতার পরিবর্তে কেমিক্যাল আনার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। এরপর কনটেইনারটি নতুন করে সিল দিয়ে বন্ধ করে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে লক করে দেয়। তারপর ৯ ডিসেম্বর সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কনটেইনারটি কিপ ডাউন করে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়, যাতে ২৪৭ বস্তা কেমিক্যাল-জাতীয় পণ্য পাওয়া যায়। একই সঙ্গে চালানটির সঠিক এইচএস কোড নির্ধারণের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে কাস্টম হাউসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়।
এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর এক কোটি ১৩ লাখ শলাকা সিগারেটের চালান জব্দ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, যাতে ২৭ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টা হয়েছিল।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার (প্রশাসন) সালাউদ্দিন রিজভী শেয়ার বিজকে বলেন, এর আগেও চট্টগ্রাম কাস্টস কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি ও দৃঢ় প্রচেষ্টায় অভিনব কায়দায় মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানিকৃত একাধিক সিগারেটের চালান বন্দরের অভ্যন্তরে আটক করা হয়। তবে কাস্টমস কমিশনারের নির্দেশে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কাস্টমস আইনে এবং প্রচলিত অন্যান্য আইন ও বিধি অনুযায়ী কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।