জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেÑএমন হাটগুলোর অন্যতম ‘করটিয়া হাট’। টাঙ্গাইলের এ হাটের বিভিন্ন দিক পাঠকের জন্য তুলে ধরেছেন শাহরিয়ার সিফাত।
‘চমচম, টমটম ও শাড়ি এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’ ছড়াটিতে টাঙ্গাইলের তিনটি ঐতিহ্য উঠে এসেছে। টাঙ্গাইলে তৈরি চমচম
মিষ্টি ও তাঁতের শাড়ির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। টমটম গাড়িও একদা ছিল টাঙ্গাইলের পরিবহন ব্যবস্থার অপরিহার্য যান।
দেশের প্রাচীন ও বৃহৎ কাপড়ের করটিয়া হাটের অবস্থান ঢাকার কাছেই। এছাড়া তুলনামূলক কম দাম ও বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ির প্রাপ্তিস্থান হওয়ায় দেশের পাশাপাশি ভারতের পাইকারি শাড়ি ব্যবসায়ীদেরও অন্যতম পছন্দের হাটে পরিণত হয়েছে এই হাট।
অনেক আগে থেকেই টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা বংশপরম্পরায় তৈরি করছেন নানা ধরনের কাপড়। সে কাপড় দেশ-বিদেশের ক্রেতার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে করটিয়া হাটের বিক্রেতাদের মাধ্যমে।
ইতিহাস
টাঙ্গাইল শাড়ির ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে করটিয়া হাটের ইতিহাস। তবে হাটটির উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। প্রায় দুইশ বছর এর বয়স বলে জনশ্রুতি আছে। প্রবীণ শাড়ি ব্যবসায়ীরা জানান, প্রাচীনকালে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা মসলিন শাড়ি বুনতেন বলে শোনা যায়। এর স্বার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে আজও টিকে রয়েছে টাঙ্গাইলের জামদানি, বেনারসি ও তাঁতের শাড়ি। অতীতে মুসলমান তাঁতিদের বলা হতো ‘জোলা’। জোলাদের সংখ্যাধিক্য ছিল টাঙ্গাইল শহর, কালিহাতী ও গোপালপুর এলাকায়। অপরদিকে যুগী বা যুঙ্গীদের নাথপন্থী ও কৌলিক উপাধি হিসেবে দেবনাথ বলা হয়। ক্ষৌম বস্ত্র বো মোটা কাপড় বোনার কাজে এদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। সুতা কাটার চরকা ছিল তাদের। পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সুতা কাটা ও কাপড় বুনতেন। যুগীরা ক্ষৌম, গামছা, মশারি তৈরি করে প্রায় স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতেন। আরও জানা যায়, টাঙ্গাইলের হিন্দু তাঁতিদের মৌলিক উপাধি বসাক। বাজিতপুর ও নলসুন্দা গ্রামেই তাদের অনেকে বাস করেন। তবে বল্লা ও রতনগঞ্জে জোলার সংখ্যা বেশি।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বসাক সম্প্রদায়ের তাঁতিরাই হচ্ছেন টাঙ্গাইলের আদি তাঁতি। অর্থাৎ আদিকাল থেকেই তারা তন্তুবায়ী গোত্রের লোক। তাদের যাযাবরই বলা চলে। শুরুতে তারা সিন্ধু অববাহিকা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে এসে তাঁতের কাজ শুরু করেন। এরপর রাজশাহীতে। পরে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর, ঢাকার ধামরাই হয়ে অনেক বসাক টাঙ্গাইলে বসতি স্থাপন করেন। এখানের আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় তারা পুরোদমে তাঁত বোনার কাজে লেগে পড়েন। এককালে জেলার বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে বসাক শ্রেণির বসবাস ছিল। তারা বসাক সমিতির মাধ্যমে অনভিজ্ঞ তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দিতেন, কাপড়ের মান নিয়ন্ত্রণ করতেন। দেশ ভাগ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অনেক বসাক ভারতে চলে যান। তখন থেকে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত হন।
দেশ ভাগের আগে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির বাজার বসতো কলকাতায়। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা চারাবাড়ি, পোড়াবাড়ি ও নলছিয়া ঘাট এবং সুবর্ণখালী বন্দর থেকে স্টিমার, লঞ্চ ও জাহাজে চড়ে কলকাতায় যেতেন। দেশ ভাগের পর টাঙ্গাইল তাঁতের প্রধান হাট ছিল জেলার বাজিতপুরে। শুধু দেশি পাইকাররাই নন, ভারত ও ইংল্যান্ড থেকেও শাড়ি কিনতে আসতেন ক্রেতারা। টাঙ্গাইল শাড়ির এমন চাহিদা আর দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের আগমন দেখে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত করটিয়া জমিদার পরিবার একটি হাটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পন্নী পরিবারের সদস্য ওয়াজেদ আলী খান পন্নী ওরফে চাঁদ মিয়া করটিয়ার বিশাল এলাকাজুড়ে একটি হাট নির্মাণ করেন। সে সময় করটিয়া ছিল একটি নদীবন্দর। সেখানে সপ্তাহজুড়ে হাট বসতো। শাড়ির পাশাপাশি গবাদিপশু, হাতে তৈরি তৈজসপত্রসহ নানা সামগ্রী বিক্রি হতো। প্রতিষ্ঠার পর পাট ও গবাদিপশুর জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে এ হাট। পরবর্তী সময়ে টাঙ্গাইল শাড়ির জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময়ের জনপ্রিয় যাতায়াত মাধ্যম ছিল নদীপথ। এ হাটটি মাহমুদগঞ্জ কাপড়ের হাট হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমান
প্রায় দুইশ বিঘা জমির ওপর হাটটি প্রতিষ্ঠিত। লক্ষাধিক ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন এখানে। শাড়ির পাশাপাশি শালের জন্যও বিখ্যাত এ হাট। এখান থেকেই অনেক জেলার কারিগরের তৈরি চাদর ভারত, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ও কয়েকটি শীতপ্রধান দেশে রফতানি হয়।
বর্তমানে সপ্তাহে দু’দিন বসে হাটটি। সপ্তাহের মঙ্গলবার বিকালে শুরু হয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে শেষ হয়। এ দু’দিন ও রাতে চলে কেনাবেচা। দেশের নানা স্থান থেকে আসা পাইকাররা এখানের শাড়ি কিনে খুচরা বিক্রি করেন। সপ্তাহে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় এখানে। খোলা মাঠে শাড়ি বিক্রির পাশাপাশি হাটে তৈরি করা হয়েছে অর্ধশতাধিক বহুতল মার্কেট। টাঙ্গাইল শাড়ির পাশাপাশি প্রিন্টের শাড়িও পাওয়া যায় এখানে। ঢাকার ইসলামপুর, নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও এনায়েতপুর থেকে শাড়ি আসে। বর্তমানে শাড়ি ও শালের পাশাপাশি লুঙ্গি, চাদর, থ্রিপিস এবং শিশুদের পোশাক পাওয়া যায় এখানে। পাইকারির পাশাপাশি চলে খুচরা বিক্রিও।
যোগাযোগব্যবস্থা
রাজধানী থেকে সড়ক বা রেলপথে যাওয়া যায় করটিয়া হাটে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকেও একই যোগাযোগ সুবিধা রয়েছে।
দরদাম
দেশের বিভিন্ন পাইকারি বা যে কোনো খুচরা দোকান থেকে প্রায় অর্ধেক দামে এই হাটে মেলে জগদ্বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি। সস্তার পাশাপাশি পাওয়া যায় আসল মানও। হ
নিরাপত্তায় ঘাটতি নেই
করটিয়া হাটে পণ্য কেনার জন্য টাকার বান্ডিল নিয়ে আসেন ক্রেতারা। এরপরও চুরি বা ছিনতাইয়ের কোনো ভয় নেই। প্রতি হাটবারে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। বিক্রি হয় হাজার হাজার পিস শাড়ি, লুঙ্গি, চাদর, থ্রিপিস ও শাল। এই বিপুল পরিমাণ পণ্য কেনাবেচায় বাইরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো টোল বা খাজনা নেওয়া হয় না।
হাটে গড়ে ওঠা অর্ধশত বহুতল মার্কেটের মালিক ও ব্যবসায়ীরা সম্মিলিতভাবে এই খাজনা পরিশোধ করেন। ফলে ক্রেতাকে বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হয় না। চলতি বছর এক কোটি ৭২ লাখ টাকা হাটের ডাক হয়েছে। সেই খাজনা পূরণ করছেন ব্যবসায়ীরা।
হাটের নিরাপত্তায় হাট কমিটির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। হাটজুড়ে স্থাপন করা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। এসব ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়। এতে দেশের নানা স্থান থেকে আসা ক্রেতা চুরি বা ছিনতাইয়ের শিকারে পরিণত হন না। এছাড়া হাটের নিরাপত্তায় নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবকও রয়েছে।
ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এ হাটের যোগাযোগব্যবস্থাও সন্তোষজনক। পণ্য কেনার পর সহজে ক্রেতারা ক্রয় করা পণ্য পরিবহনে নিয়ে যেতে পারেন। তাই ক্রেতাদের পছন্দের তালিকার প্রথম দিকেই থাকে করটিয়া হাট। হ