ইসমাইল আলী: দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেয়া হয় গত মার্চে। ২১ মার্চ পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় এ ঘোষণা আসে। যদিও সে সময় দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী এবং শতভাগ এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসেনি। ফলে ওই ঘোষণার পরও প্রতি মাসে বাড়ছে বিদ্যুৎ গ্রাহক। এর মধ্যে গত ছয় মাসে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আসা গ্রাহকসংখ্যা বেড়েছে ১৫ লাখ।
যদিও কয়েকটি দ্বীপ (অফগ্রিড এলাকা) এখনও বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে রয়েছে। সে দ্বীপগুলোয় বিদ্যুতায়নের কাজ দ্রুত শেষ করতে সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
‘বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির তথ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার সময় গত মার্চে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল চার কোটি ২১ লাখ। পরের মাসে এ গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় চার কোটি ২২ লাখ। এভাবে প্রতি মাসেই বাড়ছে বিদ্যুৎ গ্রাহক। এর মধ্যে মে মাসে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় চার কোটি ২৭ লাখ, জুনে চার কোটি ২৯ লাখ, জুলাইয়ে চার কোটি ৩২ লাখ ও আগস্টে চার কোটি ৩৪ লাখ। আর চলতি মাসে বিদ্যুৎ গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৩৬ লাখ।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের জুনের সমন্বয় সভায় জানানো হয়, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অধীনে নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া ও কুতুবদিয়ায় বিদ্যুতায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে হাতিয়ায় একটি রেগুলার ও দুটি রুরাল টাইপ ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। আর কুতুবদিয়ায় ৩৩ কেভি সাবমেরিন কেব্ল দ্বারা গ্রিড সংযুক্ত করা এবং নিঝুম দ্বীপকে হাতিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ১১ কেভি সাবমেরিন কেব্লের কাজ শুরু করা হয়েছে।
এর বাইরে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) আওতাধীন মনপুরা দ্বীপে শতভাগ বিদ্যুতায়নের জন্য আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) মডেলে গৃহীত তিন মেগাওয়াট সোলার ব্যাটারি ডিজেল হাইব্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, গত মার্চে প্রকৃতপক্ষে দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় সম্ভব হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী মুজিববর্ষের মধ্যে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণার জন্য মার্চে আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন করা হয়। তবে কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ এর বাইরে রয়ে গিয়েছিল। তাদেরই পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। আর দ্রুতই তা সম্পন্ন হবে।
যদিও শতভাগ বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময় বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ছিল ৪৭ শতাংশ। তবে গত ১৩ বছরে ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এখন শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। সম্ভাব্য সব এলাকায় সঞ্চালন লাইন স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে সরকার। একেবারের দুর্গম এলাকাগুলোয় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ গ্রাহকসংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখ। গত ১৩ বছরে তিন কোটি ১৩ লাখ বেড়ে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা হয়েছে চার কোটি ২১ লাখ। আর ২০০৯ সালে দেশে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে এ ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫১৪ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ)।
২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ২৭টি, বর্তমানে যা ১৫০টি। ১৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া ২০০৯ সালে বিদ্যুতের বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, বর্তমানে ছয় লাখ ২১ হাজার কিলোমিটার সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। দুর্গম এলাকার মানুষকে বিদ্যুতের আওতায় আনতে ৬০ লাখ সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে ‘বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতির তথ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৪টি। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৫১২ মেগাওয়াট। তবে ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হয় ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট।
যদিও গত জুন থেকে লোডশেডিং শুরুর পর উৎপাদন অনেক কমে গেছে। ১৩ সেপ্টেম্বর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৯৪ মেগাওয়াট।
প্রসঙ্গত, শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রসঙ্গে ২১ মার্চের আগে গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়েছি। যেসব জায়গায় গ্রিড লাইন নেই, সেখানে সোলার প্যানেল দিয়েছি। খুঁটে খুঁটে বের করছি, কোন জায়গায় নেই। সর্বশেষ পেলাম গঙ্গাছড়াতে ৭০টি বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। সেখানে আমি সোলার প্যানেল করে দিয়েছি। এখন কিন্তু শতভাগ বিদ্যুৎ হয়ে গেছে আমাদের দেশে, যেটা আমাদের টার্গেট ছিল।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘কিছু কিছু দ্বীপ অঞ্চলে সাবমেরিন কেব্ল দিয়ে লাইন নিয়ে গেছি, যেমন সন্দীপে নিয়ে গেছি, ভোলার কিছু অঞ্চল; তাছাড়া বেশিরভাগ স্থানে সোলার প্যানেল দিচ্ছি। গ্রিড লাইন আরও তৈরি করছি, যাতে আরও সুষ্ঠুভাবে বিদ্যুৎ দিতে পারি।’