শত বছরের মৃত্যুপুরী ফিলিস্তিন

আলী আহসান: পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ ও সংঘাত খুবই নির্মম এক বাস্তবতা। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতা অর্জন ও নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুগের ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও দেশে দেশে যুদ্ধ সংঘটিত হয়ে আসছে। আধুনিক এই বিশ্বে পোশাকি আবরণে মানুষ সভ্যতা অর্জন করলেও মানবিকতার প্রশ্নে মানুষ আজও সভ্য হতে পারেনি। অন্যের অধীনে না থেকে নিজের ক্ষমতাকে জাহির করার প্রবৃত্তি মানুষের চিরকালের।

বর্তমান বিশ্বে নিজেদের জাহির করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল। এই প্রতিযোগিতা আজকের নয়, শত বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে এই রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতা। বর্তমানে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুটিই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হলেও অতীতে দুটি একই ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় আর ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটেন সাম্রাজ্যের অধীনে। এই সময় ফিলিস্তিনে ইহুদি ও মুসলিম উভয়ই জাতির বসবাস ছিল। তবে জরিপমতে, সে সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম জাতি। পরবর্তী সময়ে ইউরোপ থেকে ইহুদিরা বিভিন্ন পর্যায়ে ফিলিস্তিনে আসে। সে সময় এক ধরনের সাম্প্রদায়িক যুদ্ধ শুরু হয়, যা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটেন। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিনকে অমীমাংসিত অবস্থায় রেখে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে। পরবর্তী সময়ে ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনে তৎপর হয়ে ওঠে এবং মুসলিমরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে ইহুদি ও মুসলিম জাতিকে পৃথক করার জন্য দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

এ পর্যন্ত বিষয়টা খুব সহজভাবেই সমাধান হয়েছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু মূল দ্বন্দ্বের শুরু হয় জেরুজালেম অঞ্চলকে কেন্দ্র করে। কারণ দুই দেশকে বিভক্ত করার সময় জেরুজালেমকে করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক নগরী। সেখানে দুই দেশ তথা মুসলিম ও ইহুদি উভয়ই জাতির প্রাধান্য ছিল। তবে ইহুদিরা এই সমন্বয়কে মানতে পারেনি। জেরুজালেম পুরো অঞ্চলটাকেই তারা নিজেদের বলে দাবি করে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও পূর্ব জেরুজালেম ছাড়তে রাজি নয়, কারণ পূর্ব জেরুজালেম মুসলিম ধর্মের এক পবিত্র স্থান। ইসরায়েলের জোর করে দখল করার চেষ্টা আর ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড টিকিয়ে রাখার লড়াই আজ শত বছর পেরিয়ে গেছে। এই যুদ্ধ ইতিহাসে দুটি জাতি কিংবা ধর্মের যুদ্ধ হলেও আজ এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নির্মমতার কাছে বিশ্ব মানবিক সত্তা পদদলিত হচ্ছে।

শত বছরের যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিন আজ মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর নীরব সহযোগিতা ও সমর্থনে ইসরায়েল নির্বিচারে হত্যা করছে ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের। একের পর এক হামলায় যখন ফিলিস্তিন মৃত্যুপুরীতে রূপ নিচ্ছে, তখনও কথিত মানবতাবাদী সভ্য আধুনিক দেশগুলো ইসরায়েলের সমর্থন করে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোয় মারাত্মকভাবে পুঁজিবাদ গ্রাস করেছে। কেননা অর্থ-বাণিজ্য তাদের কাছে মানুষের জীবনের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিনের ওপর যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে যখন গোটা বিশ্ব ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা চালাচ্ছে, তখনও নীরব সমর্থন করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু পশ্চিমা দেশ।

হাসপাতালে অসুস্থ মানুষ ও শিশুদের লাশের স্তূপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। ইহুদিদের মূল টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন ফিলিস্তিনি শিশুরা, কারণ তারা মনে করছে এই ভবিষ্যৎ প্রজš§কে হত্যা করা হলে এই যুদ্ধ পুরোপুরি শেষ হবে এবং ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড তাদের দখলে যাবে চিরতরে। শত বছর ধরে চলে আসা এই যুদ্ধের সমাপ্তি হিসেবে ইসরায়েল যে লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগুচ্ছে, তা ব্যতীত হয়তো এর সমাধান সম্ভব নয়। বিষয়টি নির্মম হলেও এটাই বাস্তব। কেননা প্রতিনিয়ত যেভাবে ফিলিস্তিনের শিশুদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, তাতে করে এই জাতির অস্তিত্ব হয়তো আর বেশিদিন টিকবে না।

চোখের পলকেই বোমার বিস্ফোরণে একের পর এক বিল্ডিং ভেঙে যাচ্ছে। এমনকি ইসরায়েলি বাহিনী হাসপাতালগুলোকেও অক্ষত অবস্থায় রাখছে না। ফিলিস্তিনের আকাশে কান পাতলেই ইট-পাথরের ভাঙা স্তূপ থেকে মানুষের চিৎকার ও আর্তনাদ ভেসে আসছে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইউনিসেফ কোনো অবদান রাখতে পারছে না। জাতিসংঘের মহাসচিব বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছেন, কিন্তু শুনছে না কেউ। এই সংস্থা একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পৃথিবী উপহার দিতেই বদ্ধপরিকর বলে প্রচার করা হয়। অথচ আজ ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ভয়াবহ এই যুদ্ধের শিকার হয়ে অসংখ্য শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। কারও এক চোখ নেই, হাত নেই, পা নেই, বীভৎস হয়ে গেছে মুখমণ্ডল। সারা পৃথিবীর বুকে ফিলিস্তিন যেন একখণ্ড নরক। আর এই শিশুগুলোকে দেখলে মনে হতে পারে নরকে দীর্ঘদিন ধরে শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদি। আধুনিক সমাজে বসবাস করেও আজ আমাদের এসব কথা বলতে হচ্ছে, কারণ আমরা শুধু পোশাকি আবরণেই সভ্য। এই আধুনিক বিশ্বে মানবিক সত্তা আজ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে। আর এজন্যই ফিলিস্তিনের শিশুদের হাহাকার আমাদের বিশ্ব মানবিক সংস্থাগুলোর টনক নাড়াতে পারছে না। চোখ মেলে শত বছরের যুদ্ধকে আমরা দেখে যাচ্ছি আর ফিলিস্তিনকে মৃত্যুপুরী বলে নাম দিয়েছি।

শিক্ষার্থী

বাংলা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০