মেহেদী হাসান, রাজশাহী: বাঙালি ও বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্পের আদিম নিদর্শন পদ্মাপাড়ের রাজশাহী কলেজ। ভবনগুলোর শৈল্পিক-সুদৃঢ় কাঠামো অনায়াসে ভাবনার জগতে দাগ কাটে যে কারোর। উপমহাদেশে শিক্ষার বিস্তারে ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ রাজা হরনাথ রায় চৌধুরীর বদান্যতায় গড়ে উঠে এ শিক্ষা মহীরুহ। কালান্তরের যাত্রী হয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানে আনুমানিক কয়েক দশক পর প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণে যোগ হয় জাদুঘর। তবে বিগত এক পুরুষ ধরে খোঁজ নেই জাদুঘরটির। বর্তমান কলেজ প্রশাসনের তথ্যমতে, শত বছর তালাবদ্ধ-অন্ধকারে রয়েছে রাজশাহী কলেজের সংগ্রহশালা বা জাদুঘর!
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফুলার ভবন, প্রশাসন ভবন, হাজী মুহম্মদ মুহসীন ভবনসহ কলেজটির রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু স্থাপনা। তবে আদিম জাদুঘর সম্পর্কে জানেন না কলেজের শিক্ষার্থীরা। এমনকি কলেজের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আড়ালে রয়েছে এ গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। শিক্ষার্থীদের কাছে এ যেন নতুন কোন আবিষ্কার!
গত মঙ্গলবার কলেজের লাইব্রেরিয়ান মো. মহিউদ্দিন জানালেন, কলেজ জাদুঘর সম্পর্কে তিনি জানেন না। পরে কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেকের কাছে গেলে তিনি উপাধাক্ষ প্রফেসর মো. ওয়ালিউর রহমানকে দায়িত্ব দিলেন প্রতিবেদককে দেখানোর জন্য। কিন্তু পেলেন না সেই জাদুঘরের চাবি। পরের দিন গেটম্যান মো. শাহীন আলম খুললেন সেই জাদুঘরের তালা। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন কলেজ উপাধাক্ষ প্রফেসর মো. ওয়ালিউর রহমান।
ভেতরে ঢুকতেই চোখ আটকে গেলো দেয়ালে, টানানো রয়েছে পুরোনো ছবি। ছবিতে নেই কোন নাম-পরিচয়। আন্দাজে আবছা ধারণা দেশি-বিদেশি কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ কিংবা বিখ্যাত কোনো মনীষী। জাদুঘর নামক জায়গাটি মোটেই একটি মাত্র কক্ষ। রয়েছে দুটি জানালা। জানালা খুলতেই মাকড়সার জাল ডিঙ্গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠেলে আলোর রশ্মি ভেতরে ঢুকল। ধুলোপড়া একটা টেবিল ও দুটি কাঠের আলমারি জানান দিলো তারা এখানকার বাসিন্দা। আলমারির পেট খালি; নেই বই পুস্তকের বালাই। আরও ছোটখাটো পরিবারের সদস্য হিসেবে নিচে পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলে একটি ফ্যান ও কাঠের তিনটি পাখা। পাশে দেয়ালে সাঁটানো তাকে সাজোনো রয়েছে ব্রিটিশ আমলের বই। তবে ধুলোপড়া কভারে; ছিঁড়ে যাওয়া পাতায় বোঝার উপায় কোন আমলের বই সেগুলো। সেই বইগুলোতেও নেই কোনো সংরেক্ষণের আলামত। ছিল না কোনো সাল তারিখ। এ যেন প্রাচীন পুঁথি চর্যাপদ আবিষ্কারের নেপালের গোয়ালঘর!
নিয়ে আসো হলো টর্চলাইট। এবার যেন চোখের পর্দা নড়েচড়ে বসল। ব্রিটিশ আমলের ঘড়ি রয়েছেÑআটটি, রেডিও তিনটি, আয়না তিনটি, একটি মূর্তি, দুইটি বিজয়ী মেডেল একটি চ্যাম্পিয়ন অন্যটি রানার্স আপ, বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ১২টি ছবি, কাঠের ওপর প্রিন্টিং করে বিভিন্ন ঐতিহ্যের ছবি রয়েছে ৩৪টি।
এছাড়া একটি রয়েছে অফিশিয়াল ডেস্ক, ছয়টি বিভিন্ন ঝাড়বাতি, মাইক্রোস্কোপ দুইটি, একটি নিকতিসহ বিভিন্ন সায়েন্সের ইন্সট্রুমেন্ট রয়েছে মোট ছয়টি। রয়েছে কাগজ প্রিন্টিংয়ের জন্য ব্যবহƒত একটি প্রিন্টার মেশিন, টেস্টটিউব স্যান্ড, প্রিন্টিং অলমেট রয়েছে দুইটি ও বিভিন্ন সময়ের শিক্ষকদের একটি ওনারবোর্ড রয়েছে। এছাড়া একটি বড় টেবিল ও একটি চেয়ার ছিল যেটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান কলেজ অধ্যক্ষ।
আধুনিক রাজশাহী কলেজের রূপকার সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান জানান, এসব বস্তুগত ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন জিনিসের ছবি স্ক্যান করে ডিজিটাল আর্কাইভে রেখেছিলেন। তবে সেগুলোর কাগজে ডকুমেন্ট বা সাল তারিখ না জানার কারণে বিস্তারিত রাখা সম্ভব হয়নি।
এই শিক্ষাবিদ হবিবুর রহমান বলেন, এসব নিদর্শন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিকাশের উৎস। আমার মনে হয় সবার আগে এ নিদর্শনগুলো হেফাজতে নেয়া দরকার। এত পুরোনো নিদর্শন আর পাওয়া যাবে না। সেজন্য আর্কাইভ করা উচিত। ঐতিহ্য নিয়ে একটি স্মারক লেখা হয়। সেই স্মারকে এগুলোর নাম ঠিকানা ছিল শুনেছিলাম। তবে সে স্মারকগুলো নাকি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল না জানা বসত। তাই পরে আর বিস্তারিত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
বস্তুগত নিদর্শনগুলো কতটুক সংরক্ষণ করা জরুরি বলে মনে করেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তবে ঘড়ি মিটসেফ আলনাসহ বেশ কিছু বস্তুগত নিদর্শন রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করা অতীব জরুরি। শুধু তা-ই নয়; বর্তমানে যেগুলো হবে সেগুলোও কিন্তু সংরক্ষণ করা জরুরি। কারণ ৫০ বছর পর এগুলো একটা ইতিহাস হবে। কলেজের প্রত্যেকটা জিনিস সংরক্ষণ করা জরুরি চিঠিপত্র বা বিভিন্ন জায়গার ছবি সংরক্ষণ করা এবং ডিজিটাল আর্কাইভে রাখা খুবই দরকার।
কলেজের ঐতিহ্য নিয়ে একটি জাদুঘর বা ঐতিহ্য স্থাপনা রয়েছে সে বিষয়ে তার কোন ধারণা আছে কি না জানতে চাইলে অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌ বিশ্বাস বলেন, কলেজটি আমাদের বেশ সুন্দর লাগে। তবে কলেজের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে এরকম কোনো স্থাপনা আছে কি না আমার জানা নেই। আমার মনে হয় কোনো শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে অবগত নন। তবে সেটি সম্পর্কে আমাদের শিক্ষকরা যদি ধারণা দেন তাহলে সেটি যদি সরাসরি আমরা দেখতে পাই সেখান থেকে আমরা বেশ উপকৃত হব।
ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান জানান, তারা আসেন, ক্লাস নেন, চলে যান। কেবলই তাদের বিভাগের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিহাস চর্চার সুযোগ নেই। শুধু শিক্ষকরাই দায়ী নয়; এখানে শিক্ষার্থীদের অনেক দায়বদ্ধতা রয়েছে। তারা ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করছে না।
কলেজের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে শ্রেণিকক্ষে তেমন চর্চা নেই স্বীকার করেন একাধিক শিক্ষক। তারা জানিয়েছেন, কলেজের লাইব্রেরিতে এ নিয়ে সমৃদ্ধ বই-পুস্তক রয়েছে। যে কেউ চাইলে সেখান থেকে জেনে নিতে পারেন কলেজের ইতিহাস। নিজেকে করতে পারেন আরও বেশি সমৃদ্ধ। ইতিহাসের অংশ রাজশাহী কলেজ। এ ইতিহাস চর্চার দায়িত্ব সবার।
এ বিষয়ে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, রাজশাহী কলেজ একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ। দীর্ঘ সময় এ পথ পরিক্রমায় বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিরা এসেছিলেন। এই কলেজের বিভিন্ন ব্যক্তি কলেজে দায়িত্ব পালন করেছেন আবার বের হয়েও গেছেন। এছাড়া কিছু ব্যবহার্য জিনিস রয়েছে। যেহেতু কলেজ সার্ধশতবর্ষ বছর পদার্পণ করল। সেখানে বেশ কিছু নিদর্শন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এখানে কিছু সংরক্ষণ রয়েছে। তবে বেশি কিছু যে আছে সেটা বলা যাবে না। সর্বমোট ৩০ থেকে ৩৫ রকমের জিনিসপত্র হবে। তবে এ ঘরটি যে সব সময় খুলে রাখা হয় সেটি করা হয় না। প্রয়োজন হয় ঠিক তখনই খোলা হয় যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির দেখাশোনা করতে আসলেন আর তখন শুধু খোলা হয়।
তিনি আরও বলেন, এই কক্ষটি লাইব্রেরির অংশ করে লাইব্রেরিয়ানকে দায়িত্ব দিয়ে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা যায় সেটিকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। এছাড়া চিহ্নিত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেটি আমরা করব। যদিও সাল তারিখ সেভাবে পাওয়া যাবে না, তবে যতটুক সম্ভব ততটুকু আমরা আইডেন্টিফাই করার চেষ্টা করব। পরে যাতে যেকোনো মানুষ এসে বুঝতে পারে, এটি রাজশাহী কলেজের ঐতিহ্যের স্থান।
কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বা আমরা যে বিভিন্ন জাদুঘর বা সংগ্রহশালায় যায়, সেখানে আমরা দেখি বিভিন্ন সময়ের বই পুস্তক বা বিভিন্ন আসবাবপত্র। ঠিক তেমনি রাজশাহী কলেজের চেয়ে একটি সার্ধশত বছরের ইতিহাস রয়েছে, কখন কী ঘটেছে কখন কোন শিক্ষক ছিলেন এ সম্পর্কে ধারণা পাবে।