Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 1:36 pm

শহিদদের ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হোক বৈষম্যহীন সমাজ

রেজাউল করিম খোকন: মৃত্যুর ৩৬ দিন পর বাবা হয়েছেন রুবেল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৪ আগস্ট কুমিল্লার দেবিদ্বারে গুলিতে নিহত আবদুর রাজ্জাক রুবেলের স্ত্রী হ্যাপী আক্তার ছেলেসন্তানের জš§ দিয়েছেন। নিহত আবদুর রাজ্জাক রুবেল দরিদ্র ছিলেন। বাস চালিয়ে সংসার চালাতেন তিনি। তার অকাল মৃত্যু এবং সন্তানের জšে§র পর পুরো পরিবার এখন দিশাহারা। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, আবদুর রাজ্জাক রুবেল ছিলেন তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর রুবেলই পরিবারের হাল ধরেছিলেন। রুবেলকে হারিয়ে এক মাস ধরে দুর্বিষহ জীবন পার করছে তার পরিবার। নিহত রুবেলের বৃদ্ধা মা হোসনেয়ারা বেগম নাতিকে কোলে নিয়ে কাঁদছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে তিনি বলেন, ‘বাবা রে আমার ছেলে আজ বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতো। কপালপোড়া নাতিটা জšে§র পর তার বাবার মুখ দেখতে পারল না। বড় হয়ে বাবাকে খুঁজলে আমি কী জবাব দেব?’ রুবেলের স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামীর ইচ্ছা ছিল ছেলেসন্তান হলে রাইয়ান নাম রাখবেন। নাম রাইয়ানই রাখা হয়েছে। আমার একটি সুখী পরিবার ছিল, একটি গুলিতে নিভে গেল সব। সন্তানের মুখ যেতে পারল না তার বাবা।

আমার স্বামীর কী অপরাধ ছিল, তাকে কেন ঘাতকরা গুলি করে মারল? দেশের জন্য শহিদ রুবেলের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি। তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচারী হাসিনার পতন হয়েছে। প্রসঙ্গত, আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট দেবিদ্বার উপজেলা সদরে ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ চালায় আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। সে সময় সন্ত্রাসীরা আবদুর রাজ্জাক রুবেলকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত শহিদদের তালিকা করা হচ্ছে। গত জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৭৬১ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি। খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি নিহত ও আহত হয়েছেন। সারাদেশে আহত হয়ে যারা হাসপাতালে গেছেন, তাদের মধ্যে তিন হাজার ৪৮ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। তাদের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। কমপক্ষে ৫৩৫ জন স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪৫০ জনকে হাসপাতালে আনা হয় মৃত অবস্থায়। বাকি ১৮১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। আন্দোলনে হতাহতের তালিকা করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। তালিকার কাজ এখনও চলছে। আন্দোলনের সময় মামলার ভীতিসহ নানা কারণে নিহত অনেককে হাসপাতালে আনা হয়নি। এ কারণে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছররা গুলিতে ৪০১ জনের চোখ নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ জন দুই চোখেরই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এক চোখ নষ্ট হয়েছে ৩৮২ জনের।

এ ছাড়া দুজনের দুই চোখে ও ৪২ জনের এক চোখে গুরুতর দৃষ্টিস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত চোখে আঘাত নিয়ে ৮৫৬ জন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে ৭১৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। চোখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে ৫২০ জনের। গুলিতে যারা দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ছয় শিক্ষার্থী। বাকিদের মধ্যে শ্রমিক, গাড়িচালক ও চাকরিজীবী দুজন করে ছয়জন। একজন শিক্ষক। অন্য ছয়জনের পেশাগত পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন, সেই আন্দোলন থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সরকারপ্রধানের দেশ ছেড়ে পলায়ন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন দেশের ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহতদের মৃত্যুসনদ পরিবর্তন করতে চিকিৎসকদের ‘প্রশাসন’ নির্দেশ দিয়েছিল।

গুলির ঘটনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে মৃত্যুসনদ দিতে বলা হয়েছিল। ঢামেকে এত লাশ ধারণের সক্ষমতাও ছিল না। হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশি মামলায় রিমান্ডের শিকার ব্যক্তিদের দায়িত্বরত চিকিৎসক মানসিক ও শারীরিক চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। বাকিরা শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে ট্রমার শিকার হয়ে বেঁচে থাকবেন। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে আজিমপুরে একজন ভদ্রলোক পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। তখন প্রশাসন চিকিৎসকদের নির্দেশ দিয়েছিল, পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, এটা ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা যাবে না। লিখতে হবে, তিনি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে নতুন এক বাংলাদেশ। গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্ররা যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল, তাদের আত্মত্যাগের ফলে আজ আমরা নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। আন্দোলনে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের দেশ মনে রাখবে। নাম না জানা অনেক ছাত্র-জনতা এ আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। তাদের তালিকা করা হচ্ছে। শহিদদের জন্যই আমরা বেঁচে আছি, স্বাধীনভাবে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারছি। এখন থেকে যেকোনো সময়, যেকোনো প্রয়োজনে শহিদদের পরিবারের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের শহিদদের অবদান স্মরণে ১৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে একটি স্মরণসভা করতে যাচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। রাজধানীর বিআইসিসিতে অনুষ্ঠেয় এ স্মরণসভার অনুষ্ঠান আয়োজনে ওই সভায় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শহিদ পরিবারের সদস্য ও শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা-ব্যবস্থার সংস্কারকামী আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ গালাগাল দিয়ে এবং দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন নস্যাতের অপপ্রয়াস চালিয়ে হাসিনা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে স্বৈরাচার পতনের গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তর করেছিলেন। সবচেয়ে জঘন্য পদক্ষেপটি ছিল ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে তাদের হত্যালীলায় ঠেলে দেয়া। ১৭-১৮ জুলাই ও ৪-৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে শত শত মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

১৯ জুলাই রাত ১২টা থেকে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল আন্দোলন দমনের জন্য। ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন আন্দোলনের সমন্বয়কেরা। তখন ঢাকার চারদিক থেকে লাখো মানুষের মিছিল ছুটতে শুরু করেছিল ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে। ঢাকা থেকে পালিয়ে যেতে মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটায় যখন হেলিকপ্টার তাকে নিয়ে ঢাকা থেকে ভারতের উদ্দেশে উড়াল দিয়েছিল, তখন প্রায় ২০ লাখ মানুষের মিছিল রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ছুটে যাচ্ছিল। এই লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় জড়ো হয়ে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও পলায়ন উদ্যাপন করছিল। ঊনসত্তরের সেই অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চিত্র ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে। সেনাশাসক এরশাদ যেদিন বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনানিবাসে ফিরে গেলেন, সেদিন ঢাকা শহর ছিল মিছিলে মিছিলে একাকার। কিন্তু এবারের মিছিলের সঙ্গে সেই মিছিল, এবারের গণজাগরণের সঙ্গে সেই গণজাগরণের কোনো তুলনা হয় না। সেবার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থী জোটসহ বিভিন্ন দল।

এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পেশাজীবীরাও। কিন্তু এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশিরভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তারা বিরল যূথবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। শতাধিক সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক নিয়ে অতীতে কোনো আন্দোলন এ দেশে গড়ে ওঠেনি। ডিবি অফিসে আটক থাকা ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে সরকার কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ানোর পরও তাদের মধ্যে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়নি। বাইরে থাকা সমন্বয়কেরা বলেছেন, এই বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি। শুরুতে তাদের আন্দোলনটি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের নিরীহ দাবিতে। যে তরুণেরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর। স্বাধীনতার অনেক পরে তাদের জš§। আন্দোলনকারী অনেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। সেই তরুণদের রাজাকারের নাতি কিংবা বাচ্চা বলে উপহাস করা কোনোভাবে মানতে পারেননি। মধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে হল ছেড়ে দলে দলে সড়কে বেরিয়ে এসেছিলেন।

তখন পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। অশান্ত হয়ে উঠেছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের উসকানিমূলক কথায়, যখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালানো হয়েছিল। সেই থেকে ক্যাম্পাসের আন্দোলন বৃহত্তর রাজপথে ছড়িয়ে যায়। ৯ দফার আন্দোলন এক দফা, অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগে গড়ায়। এরপর কয়েক দিন ঢাকার রাজপথ নয়, সমগ্র দেশ হয়ে ওঠে আন্দোলনের মুক্তাঙ্গন। এ আন্দোলনে সাত শতাধিক মানুষের আত্মত্যাগের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু নয়, সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের এই আন্দোলনে দেখা গেছে এমন কিছু দৃশ্য, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী দিনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। পৃথিবীর ইতিহাসে চীনের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে ছাত্র আন্দোলনের পরই জীবনহানি সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের এ ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন বলা যায়। বাংলাদেশের এই আন্দোলনে মানুষ হত্যাকাণ্ডের যে দৃশ্যাবলি দেখা গেছে, নৃশংস ও নির্মমতার দিক দিয়ে তা কেবল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা চলে।

সাভারের কাছে পুলিশের আর্মড পারসোন্যাল কেরিয়ার অথবা এপিসির ওপর থেকে গুরুতর আহত রাজধানীর মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়ামিনকে পুলিশ সদস্যরা যেভাবে রাস্তার ওপর ফেলে দিয়েছে, তা দেখে মানুষ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। শিক্ষার্থী ইয়ামিন গুলি ও পুলিশের পৈশাচিক নৃশংসতায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। রাস্তায় পড়ার পর তাকে নড়াচড়া করতে দেখা গেছে। তিনি টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুলিশ ইয়ামিনকে ছুড়ে ফেলেই শান্ত হয়নি। পশুর মতো টেনেহিঁচড়ে রাস্তার মাঝ বরাবর নিয়ে যায়, তারপর সড়ক ডিভাইডারের ওপর দিয়ে রাস্তার ওপর পাশে আছাড় মেরে ছুড়ে ফেলে। ততক্ষণে তিনি মরেই গেছেন। একজন আহত শিক্ষার্থীকে এভাবে মেরে ফেলার দৃশ্যটি এখনও নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দুনিয়ার যে কেউ এ নির্মম দৃশ্য দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারবেন না। শিক্ষার্থী ইয়ামিন তো আহত ছিলেন, পুলিশের উচিত ছিল এমন পাশবিক আচরণ না করে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রেও আহত শত্রুকে চিকিৎসা দেয়ার রেওয়াজ আছে। এটি যুদ্ধক্ষেত্রও নয়। তার হাতে কোনো মারণাস্ত্রও ছিল না। তাহলে এমন করে তাকে মেরে ফেলা হলো কেন? আরও একটি ঘটনায় পুলিশের তাড়া খেয়ে একজন তরুণ রামপুরার একটি নির্মাণাধীন ভবনে জালানার কার্নিশে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেন। পুলিশের একজন সদস্য তার পিছু পিছু এসে দেখতে পেয়ে খুব কাছ থেকে তিন-চারটি গুলি করে মারাত্মকভাবে জখম করে চলে যায়। তার পরপরই অন্য একজন পুলিশ সদস্য এসে আরও কয়েক রাউন্ড গুলি করে তরুণটির মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়, যা ছিল খুবই নির্মম ও বর্ণনাতীত। অথচ পুলিশ অতি সহজেই তরুণটিকে গ্রেপ্তার করতে পারত, কারণ তরুণটির জানালার কার্নিশ থেকে অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার পথ ছিল না।

পুলিশের এ বর্বর আচরণ পৃথিবীর সব মানবতাবিরোধী অপরাধকে ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশ সদস্যদের এমন বর্বর আচরণ দেখে জাতিসংঘের শিশু ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে আইনবহির্ভূতভাবে এ-কে সিরিজের অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার নিয়ে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এসব অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। অথচ এসব অস্ত্র পুলিশের ব্যবহারের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। প্রাণঘাতী অস্ত্র কখনও নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হয় না। জোর করে ক্ষমতায় আসা যায়, অনেক দিন থাকাও যায়। কিন্তু একসময় বিদায় অনিবার্য হয়। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। দেশের সাধারণ মানুষকে এ সত্যটা বুঝতে হবে, আমরা চাইলেও মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে না। সব পর্যায়ের জুলুম, অবিচার, দুর্নীতি, অনাচার ও বৈষম্য দূর করে ন্যায়ভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও প্রকৃতিবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠায় দরকার কাঠামোগত সংস্কার। প্রয়োজনীয় এ সংস্কারের জন্য বর্তমান সরকারকে সময় না দিলে আমাদের চারপাশে ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসর ও আয়নাঘরের জনক-জননীরা আবার আমাদের জাহিলিয়াতের যুগে ফেরত নিয়ে যাবে। লেখার শুরুতে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বৈষম্যবিরোধী জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আত্মদানকারী কুমিল্লার এক দরিদ্র বাসচালক
রুবেলের মৃত্যুর প্রায় এক মাস পর পুত্রসন্তানের বাবা হওয়ার কথা তুলে ধরেছি।

সদ্যজাত শিশুটি তার বাবার মুখ দেখতে পায়নি। রুবেলের অকাল মৃত্যুতে তার গোটা পরিবার সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা ও চরম অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিপাকের মধ্যে পড়ে গেছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ এই আন্দোলনে আত্মদানকারী প্রতিটি শহিদ পরিবারে আজ অসীম শূন্যতা গ্রাস করেছে। কেউ প্রিয় সন্তান, আবার কেউ স্নেহশীল পিতা, কেউ আবার আদরের ভাই হারিয়ে ফেলেছেন গত জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত আন্দোলনের ভয়ংকর সময়ে। টগবগে উচ্ছল প্রাণবন্ত উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী, যুবক, কিশোর কিংবা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি হঠাৎ এভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে পৃথিবী থেকে নির্মমতার শিকার হয়ে বিদায় নেবেন, কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। দেশ আজ দীর্ঘ সময় ধরে চেপে বসা দুঃসহ দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ভয়ংকর নির্যাতন, অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে এদেশের সাধারণ মানুষ। আজ নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার উšে§াচিত হয়েছে। আমরা সবাই মুক্তির স্বাদ অনুভব করছি। কিন্তু আজকের এই বিজয় অর্জন, স্বৈরাচারমুক্ত পরিবেশে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারার সুযোগ লাভÑএ সবকিছুই আমরা অর্জন করেছি শত শত তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে, অসংখ্য মানুষের মূল্যবান দৃষ্টিশক্তি হারানোর মতো বেদনাদায়ক ঘটনার বিনিময়ে। এখনও হাসপাতালে, আপন ঘরে আন্দোলনের সময় স্বৈরাচারী সরকারের দোসরদের নির্মমতার শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন, কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। কেউ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়েছেন।

এত আত্মত্যাগ, বিসর্জন ও তিতিক্ষা আমরা যেন কোনোভাবেই ভুলে না যাই। যাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজকের মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, তাদের প্রতি কোনোরকম অবহেলা, অপমান, লাঞ্ছনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা যেন করা না হয়। তাদের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে শহিদদের মর্যাদা দিতে হবে। সন্তানহারা, পিতৃহারা, ভাইহারা ও বোনহারা পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসন ও সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। তাদের মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার পৈশাচিক ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের উপযুক্ত বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে আত্মদানকারী শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানানো সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে তাদের আত্মা শান্তি পাবে। আত্মদানকারী শহিদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আমরা তাদের ভুলব না কোনোভাবেই।