শাকসবজি ও দেশীয় ফলমূল প্রসঙ্গ প্রসূতি মা ও শিশু

রিয়াদ হোসেন: নিন্ম আয়ের স্বল্পশিক্ষিত মোহাম্মদ আলীর ৬ বছরের ছেলেটা প্রায়ই বায়না ধরে মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার। কিন্তু যার নুন আনতে পান্তা ফুরায়, সে মোহাম্মদ আলীর সাধ্য কি ছেলের বায়না পূর্ণ করে। অনেক সময় ছেলে রফিক বায়না পূর্ণ না হওয়ায় কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই শুয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে রফিক। যে বয়সে তার দুরন্তপনায় বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়সে সে ঘরে শুয়ে থাকে। যখন তার সঙ্গীদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার কথা, তখন রফিক একাকী বিষন্ন হয়ে বসে থাকে। যখন তার ছোটাছুটি করে খেলাধুলা করার কথা, তখন সে বসলে উঠতে পারে না, দৌড়াদৌড়ি দূরের কথা, হাঁটা-চলাফেরা করতেও কষ্ট হয়। মোহাম্মদ আলী দুশ্চিন্তায় পড়ে দোষ দিতে থাকে কপালের, আর ভাবতে থাকে গরিব না হলে সে ছেলেকে মাছ-মাংস খাওয়াতে পারত আর তার ছেলেটা তখন হয়ে উঠত চঞ্চল চটপটে।

 এর মাঝে তাদের এলাকার স্বাস্থ্যকর্মী জাবেদা খাতুন আসে মোহাম্মদ আলীর বাসায়। দেখে নির্জীব রফিককে। রফিকের মা রাজিয়া জানায়, তাদের দুর্ভাগ্যের কথা। রফিককে মাছ-মাংস খাওয়াতে না পারার আক্ষেপের কথা। স্বাস্থ্যকর্মী জাবেদা খাতুন ধৈর্য সহকারে শোনে মোহাম্মদ আলী ও রাজিয়ার দুঃখের কাহিনি। অতঃপর জোবেদা তাদের বুঝিয়ে বলে, দেশীয় শাকসবজি ও ফলমূলের পুষ্টিগুণ। জাবেদা খাতুন রাজিয়াকে বুঝায় মাছ, মাংস শরীরের জন্য প্রোটিনের চাহিদা মেটায়। কিন্তু শরীরকে সুস্থ-সবল রাখার জন্য প্রোটিনের পাশাপাশি ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান প্রয়োজন। তাই বাড়ন্ত বয়সের শিশুদের সুষম খাবার খাওয়াতে হবে। প্রোটিন শুধু যে মাছ, মাংসে পাওয়া যায় তা নয়, ডাল, শিম, কাঁঠালের বিচি, শিমের বিচি ইত্যাদি খাবারেও প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন থাকে। শক্তির জন্য শর্করা জাতীয় খাদ্য যেমনÑচাল, আটা, চিনি, গুড় ইত্যাদি নিয়মিত পরিমাণমতো প্রয়োজন।

মোহাম্মদ আলী নিন্ম আয়ের হলেও তার পৈতৃক ভিটাটি একেবারে ছোট নয়। এক বিঘার ওপরে বসতভিটা মোহাম্মদ আলীর। জাবেদা খাতুন বোঝায় রাজিয়াকে সে ইচ্ছা করলে গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে বাড়ির চারপাশের খোলা জায়গায় অনায়াসে জন্মাতে পারে নতুন টাটকা শাকসবজি। জাবেদা খাতুন মোহাম্মদ আলীর আঙিনায় শাকসবজি চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ করে মোহাম্মদ আলী ও রাজিয়াকে। সে জানায়, লৌহের অভাবে মানবদেহে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। গর্ভবতী ও প্রসূতি মাসহ অল্পবয়স্ক রফিকের মতো শিশুরা অতি সহজেই রক্তস্বল্পতার শিকার হয়। রক্তস্বল্পতার কারণে শরীরে নানা রকম অসুস্থতা দেখা দেয়। কলিজা, ডিম, আটা, ডাল, গুড়, কচুশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, কাঁচাকলা এসব লৌহসমৃদ্ধ খাদ্যদ্রব্য খেলে অপুষ্টিজনিত রক্তশূন্যতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

শরীরকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে খাদ্যের ভিটামিন-এ উপাদানটি। গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মা ও শিশুদের জন্য ভিটামিন-এ অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। এর অভাবে নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। ভিটামিন-এ’র অভাবে শিশুদের রাতকানা রোগ ও চোখের ঘা হতে পারে। ভিটামিন ‘এ’ ত্বক, হাড় ও দাঁতের গঠন এবং সুস্থতার জন্য বিশেষ প্রয়োজন। গাঢ় সবুজ হলুদ রঙের শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর মিটামিন-এ পাওয়া যায়। দেশীয় ফলমূল, বিশেষ করে পাকা-আম, পেঁপে, কাঁঠাল, আনারস এবং নানা রঙের শাকসবজি যেমন কচুশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক, লালশাক, পালংশাক, গাজর, টমেটো মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদিতে প্রচুর ক্যারোটিন থাকে। ক্যারোটিন আমাদের দেহে ভিটামিন ‘এ’ তৈরি করে। এছাড়া ভিটামিন-বি মস্তিষ্ক ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। বিভিন্ন শাকসবজি যেমন শিম, বরবটি, মটরশুঁটি ও ডালে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-বি পাওয়া যায়।

ভিটামিন-সি শরীরের চামড়া, দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় অপরিহার্য। ভিটামিন-সি সর্দি-কাশির হাত থেকে রক্ষা করে এবং ক্ষত দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে। তাছাড়া ভিটামিন ‘সি’ অন্ত্রে লৌহ শোষণে সাহায্য করে। ফলে রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে ভিটামিন ‘সি’। আমলকী, পেয়ারা, আমড়া, কুল, আনারস, কামরাঙ্গা, বাতাবিলেবু, কাগজীলেবু, দেশীয় এসব ফলমূল এবং তাজা সবুজ শাকসবজি থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি পাওয়া যায়। এসব শাকসবজি ও ফলমূল খেয়ে আমরা ভিটামিন সি’র অভাব সহজেই পূরণ করতে পারি। ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড়কে সুগঠিত করে। হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু ও পেশিগুলোর স্বাভাবিক কাজে ক্যালসিয়াম সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। দুধ, ডিম ছাড়া যেমন বরবটি, লাউ, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল, শসা ও দেশীয় সব ধরনের শাকসবজি ও ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।

এসব শাকসবজি বাড়ির আঙিনায় লাগাতে সময় ও অর্থের তেমন প্রয়োজন পড়ে না। সামান্য কটা বীজ মাটিতে পুঁতে গোবর সার দিলে এসব সবজি গাছ অনায়াসে ফল দেয়। মাছ, মাংস না হোক, হাত বাড়িয়ে পুষ্টিকর শাকসবজি ফলমূল গ্রহণ করতে পারলে রফিক আর দুর্বল থাকবে না। অন্য কোনো কারণে না হোক, একমাত্র শিশু সন্তানের কথা ভেবে, আগত শিশুর কথা ভেবে, রাজিয়ার পুষ্টির কথা ভেবে মোহাম্মদ আলী এবং রাজিয়াকে সচেতন হতে হবে। এত বড় বাড়ির আঙিনাকে আলস্যে ফেলে রাখা যাবে না। সামান্য একটু সচেতনতা ও পরিশ্রমে গড়ে তোলা শাকসবজি ও ফলমূলের বাগানে বেড়ে উঠবে তাদের সন্তান, তাদের সংসার। শুধু তাই নয়, একটি দেশের জন্য প্রতিটি পরিবারের এ সামান্য প্রচেষ্টা বিরাট অবদান রাখতে পারে, সে দেশের অর্থনীতি ও অগ্রগতিতে। পাশাপাশি এমন প্রচেষ্টা পারে অপুষ্টির কবল থেকে শুধু রফিককেই নয়, সমগ্র জাতিকে মুক্ত করতে পারে অপুষ্টির ভয়াল চক্র থেকে। সফল করতে পারে সুস্থ, সবল এবং কর্মক্ষম পরিবার ও একটি জাতি বিনির্মাণে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০