রহমত রহমান:অনুমোদন নেয়া হয়েছে লিয়াজোঁ অফিস হিসেবে। কিন্তু কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে শাখা (ব্রাঞ্চ) অফিস হিসেবে। বাংলাদেশে অবস্থিত কয়েকটি বিদেশি পোশাক প্রতিষ্ঠান রাজধানীর অভিজাত এলাকায় লিয়াজোঁ অফিসের আড়ালে শাখা অফিস পরিচালনা করে আসছে। লিয়াজোঁ অফিস পরিচালনায় করহার শূন্য। আর ব্রাঞ্চ অফিস পরিচালনায় করহার ৩৫ শতাংশ। মূলত করফাঁকি দিতে বিশ্বের নামিদামি কোম্পানিগুলো এমন কাজ করে আসছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এমন ১৭টি কোম্পানির তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে ১৩টি হংকংভিত্তিক কোম্পানি এবং দুবাই, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফ্রান্সের একটি করে কোম্পানি রয়েছে। করফাঁকি দেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পৃথক প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এসব প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, বিদেশি পোশাক প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ ও ব্রাঞ্চ অফিস বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) অনুমোদন দেয়। বিডার গাইন লাইনে লিয়াজোঁ ও ব্রাঞ্চ অফিসের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ব্রাঞ্চ অফিস বা শাখা অফিস সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিদেশি নিবন্ধিত কোম্পানির পণ্য বা সেবা উৎপাদনের প্রত্যক্ষ প্রক্রিয়া ব্যতীত সীমিত আকারে বাণিজ্যিক বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিডা অনুমোদিত অফিসকে বুঝাবে। আর লিয়াজোঁ বা প্রতিনিধি অফিস সম্পর্কে বলা হয়েছে, স্থানীয় ব্যবসা বা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক পরিবেশ এবং স্থানীয় ক্রেতা বা ভোক্তাদের বিদেশি কোম্পানির পণ্য বা সেবা সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য বিদেশে নিবন্ধিত কোম্পানি বা সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে স্থাপিত অফিসকে বোঝাবে, যার স্থানীয়ভাবে কোনো আয়ের উৎস নেই বা থাকবে না। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, লিয়াজোঁ অফিস শুধু তথ্য আদান-প্রদান করবে। আর ব্রাঞ্চ অফিস ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবসায়িক কোনো লেনদেন না হওয়ায় কর দিতে হবে না। ব্রাঞ্চ অফিসে ব্যবসায়িক লেনদেন হওয়ায় কর দিতে হবে।
অপরদিকে, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে দেয়া দুইটি প্রতিবেদনে ১৭টি বিদেশি পোশাক প্রতিষ্ঠানের ‘ব্রাঞ্চ অফিসকে লিয়াজোঁ অফিস’ হিসেবে দেখিয়ে করফাঁকি দিয়ে আসছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ১৭টি পোশাক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি হংকংভিত্তিক কোম্পানি। এই ১৩টি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে অবস্থিত। বাকি চারটি কোম্পানির মধ্যে একটি দুবাই, একটি জাপান, একটি দক্ষিণ আফ্রিকা ও একটি ফ্রান্সে। ১৭টি প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ৩৫৫ জন বাংলাদেশি ও ১২১ জন বিদেশি কর্মরত। ১৭টি কোম্পানি লিয়াজোঁ অফিস ঘোষণা দিয়ে বিডা থেকে নিবন্ধন নিয়ে ঢাকায় ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।
দুইটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প ‘লিয়াজোঁ অফিস’ হিসেবে অনুমোদিত। সরেজমিনে ও গোপন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিডার গাইডলাইন অনুযায়ী সীমিত জনবল নিয়ে পরিচালনা করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো বিধিবর্হিভূত অধিক সংখ্যক জনবল বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কনসালটেন্সি করে সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এই লিয়াজোঁ অফিসগুলো ‘ব্রাঞ্চ অফিস’-এর মতো পরিচালিত হচ্ছে এবং সরকারকে করফাঁকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ব্রাঞ্চ অফিস কমার্শিয়াল কার্যক্রমের আওতাভুক্ত হওয়ায় ৩৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। অপরদিকে, লিয়াজোঁ অফিসের কর শূন্য। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ সরকারকে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে। বিডা কর্তৃক এই লিয়াজোঁ অফিসগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে ব্রাঞ্চ অফিসে পরিবর্তন করার অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে এনবিআরকে রাজস্ব আদায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়।
একটি প্রতিবেদনে ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়েছে, কেজিএস সোর্সিং লিমিটেড। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের এবিসি টাওয়ারে লিয়াজোঁ অফিস নেয়া প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত। এই অফিসে কর্মরতদের মধ্যে রয়েছে দেশি ৭১ ও বিদেশি চারজন। উত্তরা ১২ নম্বর রোডের নাভানা টাওয়ারে থাকা কেলিডার সোর্সিং এফজেডসিও-এর প্রধান কার্যালয় দুবাইয়ে। এই অফিসে কর্মরত জনবলের মধ্যে ৫৫ জন দেশি। গুলশান ২ নম্বরের সেন্টার পয়েন্ট গুলশানে থাকা ইআই কোরট ইগলেস এসএ-এর প্রধান কার্যালয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। এই অফিসে কর্মরত জনবলের মধ্যে ৭৩ জন দেশি ও ৩ জন বিদেশি। বনানীর কামাল আতার্তুকে (বাড়ি নং-৬৭ ও ৬৮) থাকা পোয়েটিসিজম ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই অফিসে কর্মরত জনবলের মধ্যে দেশি ৩০৫ ও বিদেশি ১০ জন। বারিধারা ডিওএইচএসে (বাড়ি নং-৪৪১) থাকা ডিজাইন এআরসি এশিয়া লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবলের মধ্যে ১০৫ জন দেশি ও সাতজন বিদেশি। বারিধারা ডিওএইএসে (বাড়ি নং-৪৯৩/৩) ক্রায়োন্স সোর্সিং লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবলের মধ্যে ৮০ জন দেশি ও ৬ জন বিদেশি। উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ রোডের মাসকাট প্লাজায় থাকা টেক্স-ইবো ইন্টারন্যাশনাল পিটিই লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ২৭৮ জন দেশি ও ৩ জন বিদেশি। বনানী কামাল আতাতুর্কের আহমেদ টাওয়ারে ক্লোভার কালেকশন লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৬৬ জন দেশি, ৭ জন বিদেশি। বনানীর প্রাসাদ ট্রেড সেন্টারের বেয়াওমানীর এশিয়া সোর্সিং পিটিই লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৬৫ জন দেশি ও ৪ জন বিদেশি। গুলশান ২ নম্বরের হাদী টাওয়ারের প্লাস ট্রেডিং ফারইস্ট লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৪৩৭ জন দেশি ও ১৯ জন বিদেশি।
অন্য প্রতিবেদনে সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়েছে, গুলশান ২ নম্বর রোডের ডেল্টা লাইফ টাওয়ারে থাকা ইউনিক্লো কোং লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় জাপানের রাজধানী টোকিওতে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৫৬ জন দেশি ও ১০ জন বিদেশি রয়েছেন। বারিধারা ডিওএইচএসে (বাড়ি নং-৪৯০, রোড-৮) থাকা নরওয়েস্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ১৯৪ জন দেশি ও ১৫ জন বিদেশি রয়েছেন। গুলশান ২ নম্বর রোডের ডেল্টা লাইফ টাওয়ারে থাকা পিভিএইচ ফারইস্ট লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৬০ জন দেশি ও ৩ জন বিদেশি রয়েছেন। বারিধারা ডিওএইচএসে (বাড়ি নং-৩৫২/৪, রোড-৫) থাকা জামিরা ফ্যাশন লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৬৪ জন দেশি ও ৯ জন বিদেশি। উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের আপডেট টাওয়ারে থাকা ওটিটিও ইন্টারন্যাশনাল (এইচ কে) লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ১৯৪ জন দেশি ও ৬ জন বিদেশি রয়েছেন। গুলশান এভিনিউর জাহিদ প্লাজায় থাকা ফুলি সান চায়নার প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের মধ্যে ৭৫ জন দেশি ও ৩ জন বিদেশি রয়েছেন। উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের আরএকে টাওয়ারে থাকা সিম্পল অ্যাপ্রোস লিমিটেডের প্রধান কার্যালয় হংকংয়ে। এই প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ অফিসে কর্মরতদের মধ্যে ১৭৭ জন দেশি ও ১২ জন বিদেশি রয়েছেন।
অন্যদিকে সদ্য পাস হওয়া আয়কর আইনে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের লিয়াজোঁ অফিস, রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস বা ব্রাঞ্চ অফিস; যে কোনো বিদেশি সত্তা বা ব্যক্তির স্থায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান; বাংলাদেশের বাইরের কোনো দেশের আইন দ্বারা বা আইনের অধীনে নিবন্ধিত কোনো সংঘ বা সংস্থা; ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান; ফার্ম, ব্যক্তিসংঘ, জয়েন্ট ভেঞ্চার বা ব্যক্তিদের সংগঠন বা কোম্পানি আইনে সংজ্ঞায়িত কোনো কোম্পানি বা বিদেশি সত্তাকে কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ব্রাঞ্চ বা লিয়াজোঁ অফিসকে অডিট রিপোর্ট ও রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
এ বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকার যে কোনো বিদেশি কোম্পানিকে করছাড় দেয়। তবে কোনো কোম্পানি মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যবসা করলে, তা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে আয়কর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। লিয়াজোঁ অফিস আর ব্রাঞ্চ অফিস এক হতে পারে না। কর অফিস বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। তিনি বলেন, নতুন আয়কর আইন অনুযায়ী বিদেশি লিয়াজোঁ বা ব্রাঞ্চ অফিসকে কোম্পানি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এতে এসব লিয়াজোঁ বা ব্রাঞ্চ অফিসকে অডিট রিপোর্ট ও রিটার্ন দাখিল করতে হবে। ফলে করফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকবে না।