Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 5:45 pm

শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি কতটা যৌক্তিক?

জাফর হোসেন জাকির: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে আবাসিক ছাত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠে এবং সে রাতেই শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেন। শিক্ষার্থীরা প্রাধ্যক্ষের একদিনের দুর্ব্যবহারে আন্দোলনে নামেননি। নেমেছেন দীর্ঘদিনের দুর্ব্যবহার, মতামতের প্রতি মূল্যায়ন না দেয়া, হলের ব্যবস্থাপনার প্রতি নজর না দেয়ার জায়গা থেকে। হলের আবাসিক ছাত্রীরা প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজাসহ প্রাধ্যক্ষ কমিটির পদত্যাগ, ছাত্রীবান্ধব নতুন প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগ ও হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনার দ্রুত কার্যকর সমাধান চায়। শাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের হলের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানে আশ্বস্ত করে এক মাস সময় চাইলেও প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় এবং হলের অব্যবস্থাপনার তাৎক্ষণিক সমাধান না আসায় তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। প্রক্টরীয় কমিটির উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হামলা চালায়। এমন খবর গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রধান কাজ হলো ছাত্রদের ন্যায্য দাবি নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ছাত্রলীগ ৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল; সেই ছাত্রলীগ আজ কেন শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে? কেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা করে? কেন আজ ছাত্রলীগ হেলমেট পরে লাঠি হাতে পুলিশের সঙ্গে মিশে সহপাঠীদের পেটায়? শাবিপ্রবি’র আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ছাত্রলীগের গর্বিত ইতিহাস বহন করে না। ফলে আন্দোলন শুধু সিরাজুন্নেসা হলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। উপাচার্য তার কার্যালয় থেকে বের হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী তাদের দাবিদাবা নিয়ে কথা বলার জন্য পদ আগলে দাঁড়ালে ভিসি এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে প্রবেশ করেন। ফলে শিক্ষার্থীরা আলোচনা করতে না পেরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ভবনে তালা ঝুলায়। ভিসি হলেন ছাত্রদের অভিভাবক। তার কাছে অভিযোগ করা যায়, তিনি অভিযোগ শোনেন এবং সমাধান করবেন, এটিই তো প্রত্যাশিত। ছাত্ররা তো অভিভাবকের (ভিসি) পথ আটকিয়েছেন অভিযোগ করার জন্য। অভিযোগ না শুনে ভয় পেয়ে তিনি ভবনে ঢুকে বসে থাকলেন। অথচ অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে আন্দোলন এত তীব্র হতো না। হয়তো তা পদত্যাগের দাবিও উঠত না।

স্কুলজীবনে দেখেছি, হেডস্যার মাঝেমধ্যে ক্লাসে ঢুকে খোঁজখবর নিতেন। স্যাররা ক্লাসে সময়মতো আসছেন কি না, শিক্ষার্থীরা স্যারদের ক্লাস ঠিকমতো বুঝতে পারছে কি না, স্কুলের ব্যবস্থাপনার কোথাও সমস্যা আছে কি না সস্নেহে দায়িত্বশীলতা নিয়ে জানতে চাইতেন। শিক্ষার্থীরাও মন খুলে স্যারের কাছে অভিযোগ করত। যাওয়ার সময় স্যার বলতেন, ‘কারও কোনো অভিযোগ থাকলে অফিসে এসে আমাকে সরাসরি বলবে অথবা লিখিত আকারে জানাবে। আমরা জানতাম, স্যার আমাদের অভিভাবক।  ফলে সব অভিযোগ স্যারকে বলতাম এবং সমাধান করে দিতেন। স্যার এবং ছাত্রের মাঝে সম্পর্ক ছিল বন্ধুসুলভ।’

শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীরা ভিসির কাছে গেছে অভিযোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু ভিসি অভিযোগ না শুনে পুলিশ ও ছাত্রলীগকে ছাত্রদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসের ভেতরে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের মতো অস্ত্র ব্যবহার করে প্রায় ৩০ জন ছাত্রকে রক্তাক্ত করে ক্যাম্পাস রক্তে রঞ্জিত করেছেন। এর ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। আহত হয়ে পড়ে থাকা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থার করার মতো কোনো পদক্ষেপ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেয়নি বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শহিদ ড. শামসুজ্জোহা স্যারের কথা কেউ ভুলতে পারে বলে মনে হয় না। যেই স্যার ছাত্রদের বাঁচাতে আত্মোৎসর্গ করেছেন। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাবির ছাত্ররা আন্দোলনে নামলে পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পড়লে ড. শামসুজ্জোহা পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে চিৎকার করে বলেন, ‘ডোন্ট ফায়ার, আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার যেন আমার বুকে গুলি লাগে।’

আজ আমরা কী দেখছি! আমার দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ও পুলিশ দিয়ে ক্যাম্পাসের ছাত্রদের রক্তাক্ত করছেন। ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ থেকে শুরু করে রাবার বুলেট, সাইন্ড গ্রেনেডের মতো অন্ত্র প্রয়োগ করছে। তবে কী শামসুজ্জোহা স্যার ইতিহাসের পাতায় রয়ে যাবেন চিরকাল? তবে কি আর শামসুজ্জোহা স্যারকে ক্যাম্পাসে দেখতে পাব না? এমন হতাশা রয়েছে ছাত্রদের।

শাবিপ্রবির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় হামলার শিকার হয়েও আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। ছাত্ররা যৌক্তিক দাবি আদায় করে ঘরে ফিরেছে, বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তা দেখিয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি শিশুরাও সড়কে নেমেছে। এ আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে আমিও ছয় ঘণ্টা জয়পুরহাট জেলা পুলিশের রুমে আটকা ছিলাম। স্কুলের ছাত্ররা কীভাবে সারাদেশের পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এনেছে, তা ভোলার নয়। যদিও পরবর্তী সময়ে আইন প্রয়োগে শৈথিল্যের কারণে পরিবহন খাতে অনিয়ম রয়েই গেছে। কিন্তু ছাত্ররা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিছে দিয়েছিল ছাত্ররা, চাইলে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

হামলা ও মামলায় শিকার হয়েও শাবিপ্রবির ছাত্ররা আন্দোলন থেকে সরে না এসে তারা দাবি আদায়ের জন্য আমরণ অনশন করছে এবং তাদের তিন দফা দাবি এখন এক দফা দাবিতে পরিণত হয়েছে এবং ‘ভিসির পদত্যাগ চাই’। অনশনে বসেও ছাত্ররা সেøাগান দিচ্ছে, যেই ভিসি বুলেট মারে সেই ভিসি চাই না, যেই ভিসি রক্ত ঝরায় সেই ভিসি চাই না প্রভৃতি। প্রচন্ড শীতে অনশনরত শিক্ষার্থীর অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। অনেককে মেডিকেলে নেয়া হয়েছে। অনশনরত শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের ক্ষতি হলে দায়ভার কে নেবে?

শাবিপ্রবিতে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আনার জন্য ব্যর্থ ভিসিকে অপসারণ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার দ্রুত বিচার করতে হবে, শিক্ষার্থীদের নামে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং আহতদের চিকিৎসার খরচ বিশ্ববিদ্যালয়কে বহন করতে হবে।

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

নীলফামারী সরকারি কলেজ