Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 12:43 pm

শাহরাস্তিতে প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ দুই চেয়ারম্যান ও পিআইও’র বিরুদ্ধে

বেলায়েত সুমন, চাঁদপুর: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন অতিদরিদ্রদের জন্য আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) প্রথম পর্যায়ের কাজে  অনিয়ম ও অভিনব কৌশলে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা দুই ইউপি চেয়ারম্যানসহ প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। উপকারভোগীদের দিয়ে প্রকল্পের কাজ না করিয়ে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কেটে প্রকল্পের কাজ নামমাত্র শেষ করে উপকারভোগীর ভুয়া তালিকার মাধ্যমে জিটুপি (ডিজিটাল পেমেন্ট) পদ্ধতিতে টাকা উত্তোলনের অভিযোগও ওঠে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এতে সরকারের বৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতাভুক্ত কর্মক্ষম দুস্থ পরিবারগুলোর স্বল্পমেয়াদি কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও দুর্যোগ ঝুঁকিহ্রাসের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের বাস্তবায়ন ভেস্তে গেছে। ফলে উপজেলার দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন কাগজে-কলমে শতভাগ দেখানো হলেও বাস্তবতার করুণ চিত্র উঠে এসেছে শেয়ার বিজের অনুসন্ধানে।

সূত্রমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ইজিপিপি প্রভার্টি ইনডেক্স অনুযায়ী শাহরাস্তির ১০টি ইউনিয়নে প্রকল্পের উপকারীভোগী রয়েছেন এক হাজার ৯৬ জন। ইউনিয়নভিত্তিক ১০টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে দারিদ্র্যের হার দেখানো হয়েছে ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে চিতোষী পূর্ব ইউনিয়নে উপকারভোগী রয়েছে ১১১ জন, চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নে ১২৫ জন, মেহের উত্তর ইউনিয়নে ৫২ জন, মেহের দক্ষিণ ইউনিয়নে ৬৫ জন, সূচীপাড়া উত্তর ইউনিয়নে ১২৮ জন, সূচীপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নে ১২৯ জন, টামটা উত্তর ইউনিয়নে ১৩৯ জন, টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নে ১৩২ জন, রায়শ্রী উত্তর ইউনিয়নে ১০৩ জন ও রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নে ১১০ জন উপকারভোগী। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের উপকারভোগী শ্রমিক ও সর্দার মজুরি জিটুপি পদ্ধতিতে পরিশোধ করতে বিকাশ মোবাইল ফাইন্যান্সিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। চুক্তি ও প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী উপকারভোগীদের কাজের মজুরি তাদের মোবাইল ফোনে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও প্রকল্প কমিটির চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজশে এক্সকাভেটর দিয়ে প্রকল্প এলাকায় মাটির কাজ নামমাত্র শেষ করে ভুয়া উপকারভোগীর মোবাইল ফোন নম্বর ও তালিকা দিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রকল্পে বরাদ্দকৃত টাকা জিটুপি পদ্ধতিতে পরিশোধ করতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে দাখিলকৃত উপকারভোগীদের ফোন

নম্বর-সংবলিত তালিকা যাচাইবাছাই করে বাস্তবায়ন, চূড়ান্তকরণ ও অনুমোদন দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রায়শ্রী দক্ষিণ ইউনিয়নে মোট উপকারভোগী রয়েছেন ১১০ জন। ইউনিয়নে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রকল্প রয়েছে পাঁচটি। এর মধ্যে ৪নং ওয়ার্ডের আহম্মদ নগর মনিরের দোকান থেকে চটকি বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ ও প্রসন্নপুর পশ্চিম পাল বাড়ির মন্দিরের ডোবা ভরাটের জন্য ২৩ উপকারভোগীর প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে তিন লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এ রাস্তায় এক টাকার কাজও হয়নি। প্রসন্নপুর পালবাড়ির ডোবা ভরাট করা হয়েছে নামমাত্র। এমনকি প্রকল্প এলাকায় প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী সাইনবোর্ডও লাগানো হয়নি। ৬নং ওয়ার্ড ঘুঘুরচপ উত্তর পাটওয়ারী বাড়ি থেকে হাজীবাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে উপকারভোগী রয়েছেন ২০ জন। প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। এ রাস্তায় আগে থেকে ইটের সলিং থাকলেও প্রায় ১৫০ মিটার ইটের সলিংয়ের রাস্তার পাশে নামমাত্র মাটি দিয়ে প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা। ইউপি চেয়ারম্যান বলেছেন, ট্রাকে করে মাটি এনে রাস্তার পাশে দেয়া হয়েছে। ৭নং ওয়ার্ডের খিলা মনির উদ্দিন ভূইয়া বাড়ি থেকে খন্দকার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে উপকারভোগী রয়েছেন ২০ জন। প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। এ প্রকল্পেও নামমাত্র রাস্তার পাশে মাটি দিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয়েছে। ৮নং ওয়ার্ড বেরনাইয়া নুর আলমের বাড়ি থেকে খিলা মোল্লা বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পে উপকারভোগী রয়েছে ২৭ জন। চার লাখ ৩২ হাজার টাকার এ প্রকল্পে বেরনাইয়া নূর আলমের বাড়ি থেকে খিলা মোল্লা বাড়ি পর্যন্ত প্রকল্প দেয়া হলেও কাজ হয়েছে নূরুল ইসলাম তালুকদার বাড়ি থেকে ছফিউল্লা মার্কেট পর্যন্ত। এ প্রকল্পেও নিয়ম অনুযায়ী মাটির কাজ করা হয়নি। এমনকি প্রকল্পের চেয়ারম্যানও জানেন না কত টাকার প্রকল্প এটি। প্রকল্পের চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশার বলেন, প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।

প্রকল্পের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান মো. আবদুর রাজ্জাক শেয়ার বিজকে বলেন, ওয়ার্ডের মেম্বার প্রতিটি প্রকল্পের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের অধীনে কাজ হয়েছে। কাজে অনিয়ম হলে দায় প্রকল্প চেয়ারম্যানের।

চিতোষী পশ্চিম ইউনিয়নে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রকল্প দেয়া হয়েছে ছয়টি। ইউনিয়নে মোট উপকারীভোগী রয়েছে ১২৫ জন। ২নং একাতরী ভূঁইয়া বাড়ি থেকে মাওলানা বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে উপকারভোগী রয়েছে ২০ জন। তিন লাখ ২০ হাজার টাকার এ প্রকল্পে এক্সকাভেটর দিয়ে রাস্তা তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে। ৩নং ওয়ার্ডের নুনিয়া বেপারি বাড়ি থেকে জাহাজি বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পেও একই অভিযোগ উঠেছে। ৬নং ওয়ার্ড উঘারিয়া নুর বক্সের বাড়ি থেকে উঘারিয়া উত্তরপাড়া জামে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ প্রকল্প, ৭নং ওয়ার্ড জয়নগর নাপিত বাড়ি থেকে রাজারামপুর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প, ৯নং ওয়ার্ডে খেড়িহর মিজি বাড়ি থেকে তেরি বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুনর্নির্মাণ করার প্রকল্প নিয়েও অভিযোগ উঠেছে। যদিও ইউপি চেয়ারম্যান জোবায়েদ কবির বাহাদুর প্রকল্প এলাকায় এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা মীর হোসেন বাবুল বলেন, ৪০ দিনের কর্মসূচিতে অতিদরিদ্রদের জন্য এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি কাটায় এ দরিদ্র মানুষগুলো কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

চেয়ারম্যান জোবায়েদ কবির বাহাদুরের বিরুদ্ধে আরও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বারবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি গাড়ি-বাড়ি সম্পদ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন এক যুগের ব্যবধানে। এমন অভিযোগের একটি কপি হাতে এসেছে এ প্রতিবেদকের কাছে। তবে চেয়ারম্যান জোবায়েদ এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই জানিয়ে বলেন, আমি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করি। সরকারকে ট্যাক্স দিই।

প্রকল্পের কাজে অনিয়ম সম্পর্কে জানতে শাহরাস্তি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সবুজ মিয়ার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। এমনকি অফিসে গিয়েও পাওয়া যায়নি এ কর্মকর্তাকে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সবুজ মিয়ার বিরুদ্ধেও প্রকল্পের নিয়মনীতি না মেনে সাইনবোর্ড তৈরি করে অর্থ আত্মসাত করার অভিযোগসহ ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্পের সভাপতির যোগসাজশে প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে অর্থ আত্মসাতের অনেক অভিযোগ উঠেছিল। এর মধ্যে চেড়িয়ারা গ্রামে রাস্তা তৈরি ও বিজয়পুর গ্রামে খাল খননে অনিয়ম ব্যাপক আলোচিত। বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফা এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইজিপিপি প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠার পরও আজ পর্যন্ত তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।

এছাড়া উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নে ওয়ার্ড প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দাখিলকৃত উপকারভোগীদের তালিকা তৈরি বাস্তবায়ন ও পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণে নিয়ম মানা হয়নি বলে অভিযোগ উঠে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। ওয়ার্ড ইউপি সদস্য, প্রকল্পের উপসহকারী প্রকৌশলী, ট্যাগ অফিসার ও কমিউনিটি সদস্যদের তদারকিতে উপকারভোগীদের কাজের তদারকি, তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ ও প্রচার নিশ্চিত না করে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করার পাঁয়তারা করায় সরকারের জনকল্যাণমুখী নিরাপত্তা বেষ্টনীর উদ্যোগের প্রকৃত সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে উপজেলার অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ। এ কারণে প্রকল্পের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত না হয়ে সরকারি অর্থ লুটপাটের একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট তৈরি হওয়ায় উপজেলার দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান হয়নি।