শাহ আলী নগর হাউজিংয়ের মালিকের বিরুদ্ধে চার্জশিট

নজরুল ইসলাম: ভুয়া ইজারা দলিলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জমি দখল করেছেন। প্লট হিসেবে বিক্রিও করেছেন কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দুদকের মামলায় ফেঁসে গেছেন ঢাকার মিরপুরের শাহ আলী নগর হাউজিং এস্টেটের মালিক শমসের আলী। তার বিরুদ্ধে গত ৩১ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দেয়া হয়েছে। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শমসের আলী ২ কোটি ৭৮ লাখ ১২ হাজার ৮৬৪ টাকার সরকারি জমি মাত্র ৬৪ হাজার টাকায় ভুয়া ইজারা দলিল দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। তিনি দণ্ডবিধি ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৪০৬ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারির এক স্মারকে বলা হয়েছে, শাহ আলী নগর হাউজিং এস্টেটের মালিক শমসের আলীর নামে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অফিস থেকে কোনো জমি বা জমির অংশ ইজারা বা বরাদ্দ দেয়া হয়নি। শমসের আলী ২০০০ সালের ২০ এপ্রিল জালিয়াতির মাধ্যমে জাল বা ভুয়া ইজারা দলিল তৈরি করে ২১১৭/২০০০ নম্বর দলিল রেজিস্ট্রি করিয়ে নেন। তিনি চারটি দাগে মোট ৪.২৬৬৬ একর সরকারি জমি (অধিগ্রহণ করা) ইমারত নির্মাণের জন্য মাত্র ৬৪ হাজার টাকায় ৯৯ বছরের জন্য জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ তাকে ইজারা দিয়েছে দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন। জমি দখল করে প্লট আকারে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রিও করেছেন।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের এ স্মারকে বলা হয়েছে, আসামি শমসের আলীর দাবি করা বর্ণিত তফসিলভুক্ত জমির মালিকানা রেকর্ডপত্র অনুযায়ী তাকে বরাদ্দ দেয়ার বিষয়টি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

তদন্তকালে দেখা যায়, মিরপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সাব রেজিস্ট্রার মোখলেসুর রহমান ঠাকুর মৌজা রেটের চেয়ে কম মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করে দেন। এ ছাড়া শমসের আলীকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটর নুরুজ্জামানও সহযোগিতা করেন।

প্লট ক্রেতা সিদ্দিকুর রহমান সবুজ, শামসুল হক সবুজ, এরশাদ শাহিদ, সুলতান মিয়া, চাঁন বেপারী, মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ আল আমিন জানিয়েছেন, তারা জানতেন না তাদের কেনা প্লট সরকারি জমি। তারা ১৯৯৮ সালে শমসের আলীর কাছ থেকে প্লটের আয়তন অনুযায়ী, ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ১২ লাখ ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে কেনেন। মিরপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে সাব কবলা দলিল মূলে শমসের আলী তাদের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন।

মামলার আসামি মোখলেসুর রহমান ঠাকুর মিরপুর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের তখনকার সাব রেজিস্ট্রার ছিলেন। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি মারা যান। মামলার অন্য আসামি নুরুজ্জামান। তিনি ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মারা যান। মারা যাওয়ায় তাদের দুজনকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

মামলাটি তদন্ত শেষে উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম দুদক কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন। গত ২৩ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চার্জশিটের অনুমোদন দেয়। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মামলাটি দায়ের করেন সহকারী পরিচালক (বর্তমানে উপপরিচালক) আবদুল ওয়াদুদ।

শমসের আলীর বাবা মৃত শরাফত আলী। তিনি মিরপুর-১-এর শাহ আলী নগর হাউজিং এস্টেটে বসবাস করেন। মোখলেসুর রহমান ঠাকুরের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনায়। নুরুজ্জামানের বাড়ি মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকায়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইজারা নিয়েছেন মর্মে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে সরকারি জমি আত্মসাৎ করেন। পরে জালিয়াতি ও প্রতারণামূলকভাবে ওই জমি দখল করে প্লট আকারে বিক্রি করেন।

এজাহার থেকে জানা যায়, জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াইশ’ কাঠারও বেশি সরকারি জমি নিজের নামে লিজ নিয়ে একটি ‘নগর’ গড়ে তোলেন মিরপুরের শমসের আলী। আর সেই নগরের জমিগুলো প্লট আকারে বিক্রি করে হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মচারী ও সাব রেজিস্ট্রারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট।

রাজধানীর বিশিল মৌজার খতিয়ান নম্বর-১১৯, ১০৬, ১৬১ ও ২৮৬-এর ৫১, ৫২, ৭৬ ও ৮১ নম্বর দাগে ৪ দশমিক ২৬৬৬ একর (২৫৮.৫৮ কাঠা) জমি ১৯৬০ সালে তৎকালীন গৃহায়ন অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে (এল. এ. কেস নম্বর-১৩/১৯৫৯-৬০)। ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে গেজেট নোটিফিকেশন করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। রাজধানীর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদিত নকশা ও সুপার ইম্পোজ নকশা অনুযায়ী, এ সম্পত্তিতে জাগৃকের জমি ও ডুইপ প্রকল্পের বিভিন্ন প্লট রয়েছে। এ সম্পত্তি কাউকে ইজারা কিংবা বরাদ্দ দেয়া হয়নি।

২০০০ সালের ২০ এপ্রিল এ সম্পত্তির ইজারা দলিল (দলিল নম্বর ২১১৭/২০০০) করে নেন মিরপুরের বিশিল এলাকার শরাফত আলীর ছেলে শমসের আলী।

দলিলে ৯৯ বছরের জন্য ৪ একর জমির সেলামি দেখানো হয় মাত্র ৬৪ হাজার টাকা। অথচ গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ এ সম্পত্তি লিজ বরাদ্দ দেয়নি। জাগৃকের পক্ষে সংস্থাটির তৎকালীন অফিস সহকারী মো. নুরুজ্জামান ‘দলিল বাহক’ হিসেবে ওই দলিলে সই করেন। অথচ দলিল সই করার জন্য জাগৃকের পক্ষ থেকে নুরুজ্জামানকে কোনো ক্ষমতাও দেয়া হয়নি। অন্যদিকে মিরপুরের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার মোখলেসুর রহমান ঠাকুর জমির মৌজা মূল্যের চেয়েও কম দেখিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি করেন। এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কোনো ব্যক্তিকে লিজ দেয়ার নিয়ম না থাকলেও তিনি অন্যদের যোগসাজশে তা করিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি নিজ বা অন্যের স্বার্থে বিনা যাচাইয়ে ওই সম্পদ জালিয়াতিতে শমসের আলীকে সহায়তা করেন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০