Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 4:24 pm

শাড়ি আনারস ও কৃষিপণ্যনির্ভর টাঙ্গাইলের অর্থনীতি

শাহরিয়ার সিফাত: বাংলার ঐতিহ্যবাহী জনপদ টাঙ্গাইল। ঐতিহ্য আর ইতিহাসে সমৃদ্ধ এ জেলা। প্রাচীনকাল থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে আসছে এ জেলা। মোগল আমলে দেশ-বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা আসত এখানে। তখন থেকেই এ জেলার শাড়ি-মিষ্টিসহ নানা পণ্য সমাদৃত হয়েছিল দেশসহ সারা বিশ্বে। কালের গর্ভে এ শাড়ি-মিষ্টিসহ নানা পণ্য যোগ হয়েছে জেলার প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি হিসেবে।
‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’ ‘নদী-চর-খাল-বিল-গজারীর বন, টাঙ্গাইলের শাড়ি তার গর্বের ধন’ এ শ্লোক দুটির সঙ্গে নতুন করে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে মধুপুরের আনারস, দেলদুয়ারের শীতলপাটি, চাদর, জেলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত নানা কৃষিপণ্য।
তাঁত শাড়ি
টাঙ্গাইলের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির ভিত্তি গড়ে উঠেছে তাঁত শাড়িকে কেন্দ্র করে। বছরের পর বছর ধরে এ তাঁত শাড়ি টাঙ্গাইলকে পরিচিতি করে আসছে বিশ্বজুড়ে।
প্রাচীনকাল থেকে টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তৈরি করছেন নানা জাতের কাপড়। আর কাপড় তৈরিতে প্রয়োজন সূতো। সূতো তৈরি হয় তুলা থেকে। টাঙ্গাইলের প্রাচীন অঞ্চল মির্জাপুর উপজেলার বিখ্যাত গবেষক জেম্স টেলর মির্জাপুরের তুলার কথা লিখেছেন। এখানে বাপ্তা হাম্মাম ও অন্যান্য পাঁচমিশালী বস্ত্রের সূতো কাটা হতো তুলা থেকে। তাছাড়া বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং- এর ভ্রমণ কাহিনীতে টাঙ্গাইলের বস্ত্রশিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছে। সে দিক থেকেও বলা যায়, টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। বর্তমানে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী। শুধু তাই নয়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই এ তাঁত শাড়ি জেলার অর্থনৈতিক আয়ের একটি বড় অংশ হয়ে আছে। প্রতি বছর লাখ লাখ পিস টাঙ্গাইল শাড়ি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। গেল ঈদেও শুধু ভারতেই রফতানি হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ পিস শাড়ি।
টাঙ্গাইলের তাঁতের সঙ্গে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা জড়িত। আর টাঙ্গাইলে তাঁত রয়েছে লক্ষাধিক। এ লক্ষাধিক তাঁতের সবগুলোতেই আবার টাঙ্গাইলের শাড়ি তৈরি হয় না। টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় এ রকম তাঁতের সংখ্যা টাঙ্গাইলে ২০ হাজারেরও কম। আর এ ঐতিহ্যবাহী শাড়ি তৈরি হয় প্রধানত বাজিতপুর, পাথরাইল, নলসুন্দা, চন্ডি, বিষ্ণপুর ও বিন্নাফৈর গ্রামে। এ শাড়ির জমিনের রঙভেদে দাম ও ভিন্ন রকম-সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়ে থাকে। এর মধ্যে জামদানি বা সফট সিল্কের দাম সবচেয়ে বেশি। জামদানি শাড়ি তৈরি করা হয় আন্তর্জাতিক মান সম্পন্নভাবে।
জেলার শাড়ি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছর যাবৎ ভারতে প্রচুর টাঙ্গাইল শাড়ি যাচ্ছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে টাঙ্গাইলের শাড়ি যাচ্ছে।
চমচম
টাঙ্গাইলকে তুলে ধরার মতো জেলাবাসীর মুখে মুখে প্রচলিত বেশ ক’টি পণ্যের মধ্যে এটি একটি। এ চমচম মানে পোড়াবাড়ির চমচম। এদেশের মানুষের রসনা তৃপ্তির প্রিয় মিষ্টি এটি। শুধু বাঙালি-ই নয়, ভারতবর্ষসহ অনেক দেশেরই মানুষের প্রিয় এ মিষ্টির ঐতিহ্য প্রায় ২০০ বছরের। বাঙালি ললনার প্রিয় পোশাক টাঙ্গাইল শাড়ির যেমন খ্যাতি, তেমনি খ্যাতি এ চমচমের। এমন একসময় ছিল যখন টাঙ্গাইলের বধূরা শুষ্ক মৌসুমে টমটম বা টাঙ্গাযোগে (ঘোড়ায় টানা গাড়ি) আর বর্ষা মৌসুমে নৌকায় নাইওরে যাওয়ার সময় বাড়িতে তৈরি পিঠা-পুলির সঙ্গে নিতেন চমচমের হাঁড়ি। সে সময় চমচমসহ সব মিষ্টিই বিক্রি হতো মাটির হাঁড়িতে। এখন সেখানে স্থান করে নিয়েছে কাগজের প্যাকেট।
শুধু টাঙ্গাইল নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে পোড়াবাড়ির চমচম পরিবেশন করা হলে অনুষ্ঠানের মান বিশেষ মাত্রা পায়। আর টাঙ্গাইলে বৈশাখী উৎসবে পান্তা-ইলিশের পাশাপাশি চমচম না থাকলে যেন অনুষ্ঠানই জমে না। চমচমের জন্য বিখ্যাত টাঙ্গাইলে আরও তৈরি হয় হরেক মিষ্টি। তারও নানা বৈশিষ্ট্য থাকলেও চমচমই তাকে করেছে মিষ্টির জেলা হিসেবে খ্যাতিমান। প্রতি বছর গ্রামে গ্রামে বসা বৈশাখী মেলাগুলোতেও জিলেপি আর রসগোল্লা ছাড়াও পুরোনো ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রেখে এখনও মাটির হাঁড়িতে ভরেই বিক্রি হয় চমচম।
‘পোড়াবাড়ির চমচম’ নামটি শুনলেই জিভে পানি এসে যায়- এর অতুলনীয় স্বাদের কারণে। পোড়া ইটের মতো রঙের চমচমের স্বাদের আসল জায়গাটি হচ্ছে ভেতরের গোলাপি আভাযুক্ত মৌচাকের মতো ফাঁপা নরম অংশ। দক্ষ কারিগররা দিন দিন এ বিশেষ খাবারটাকে লোভনীয় করে তুলেছেন, করেছেন ব্যাপক জনপ্রিয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ চমচম এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। টাঙ্গাইল থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে এ চমচম।
মধুপুরের আনারস
শাড়ি-চমচমের মতোই টাঙ্গাইলের আরেকটি জগদিখ্যাত অর্থকরী অর্জন মধুুপুরের আনারস। রসালো আনারস ফলটি উত্তরের মেঘালয় থেকে মধুপুর গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের মাধ্যমে প্রথম চাষাবাদ শুরু হয়। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের ফল এটি। ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে এর আদিনিবাস। বৈজ্ঞানিক নাম এনান্যাস সেটাইভ্যাস। পর্তুগিজ এনান্যাস থেকে আনারস শব্দের উৎপত্তি। অর্থ চমৎকার ফল। রাসায়নিক বিচারে ব্রোমাইল অ্যালকোহলের জন্য আনারস স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। রসালো আনারস রেড ইন্ডিয়ানদের ধর্মীয় উৎসবের অন্যতম উপকরণ। তৈরি হয় উন্নত মানের মদ। খ্রিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯৩ সালের নভেম্বরে আমেরিকা আবিষ্কার করেন। ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যেসব অদ্ভুত জিনিসের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন তার অন্যতম আনারস। তিনি আমেরিকা থেকে আনারস চারা ইউরোপে নিয়ে আসেন। ব্রিটেনে আনারস রাজকীয় খাবারের মর্যাদা পায়। আবহাওয়া জনিত কারণে ইউরোপে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা যায়নি। পর্তুগিজ নাবিকরা ১৫৪৮ সালে প্রথম ভারতের কেরালা রাজ্যে আনারস নিয়ে আসেন।
ভারতের আবহাওয়া আনারসকে চমৎকারভাবে মানিয়ে নেয়। খ্রিস্টান মিশনারিরা সপ্তাদশ শতাব্দীতে কেরালা থেকে মেঘালয়ে আনারস নিয়ে যান। গারোপাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে শুরু হয় সফল আবাদ। গারোরা জুম চাষে আনারসকে সম্পৃক্ত করে। ১৯৪২ সালে মধুপুর গড়াঞ্চলের মধুপুর উপজেলার ইদিলপুরের আদিবাসী গারো সনাতন মৃ মেঘালয়ের গাছোয়া থেকে প্রথম আনারস চারা নিয়ে আসেন। এভাবে ইদিলপুরের পাহাড়ি টিলায় আনারস আবাদ শুরু হয়। ১৯৫০ সালের দিকে আনারসের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরু হয়। সে সময় চমৎকার রসালো ও সুস্বাদু হওয়ায় স্থানীয়দের মুখে মুখে ছড়া আকারে ছড়িয়ে পড়ে- ‘উত্তর থাইকা আইল ফল, রসে টস্ টস/ আনা আনা বিকোয়, নাম আনারস’। বর্তমানে মধুপুর ছাড়াও গড় এলাকার মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া ও ঘাটাইল উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় আনারস আবাদ হয়। দেশে ‘জায়ান্ট কিউ’ ও ‘হানি কুইন’ জাতের আনারসের চাষ হয়। এর মধ্যে ‘জায়ান্ট কিউ’ জাতটি শুধু টাঙ্গাইলেই উৎপাদন হয়। এই জাতটি ‘জলডুগী’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলায় এ জাতটির ফলন হয় না। আর ‘হানি কুইন’ জাতটি সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চলে উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে এ আনারস এখন এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপেও রফতানি হচ্ছে। ফলে জেলার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ আনারস।
চরাঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিপণ্য: যমুনা সেতুর সুরক্ষায় নদীর বেশ কয়েক স্থানে দেওয়া হয়েছে বাঁধ। এ বাঁধের ফলে প্রায় ২০ বছর ধরে যমুনা নদীর পূর্ব তীরে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও কালিহাতীতে জেগে উঠছে চর। প্রতি বছরই একটু একটু করে বাড়ছে চরের ব্যাপ্তি। চরগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে আবাদ হচ্ছে নানা ফসল। অনেকেই বলছেন, এ যেন বালুচরে শস্যবিপ্লব।
গত কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধু সেতু ঘিরে যমুনা নদীর টাঙ্গাইল অংশে গড়ে উঠছে শত শত একর চর। এক সময় যমুনা নদীতে জেগে ওঠা চরের বিস্তীর্ণ জমি পতিত পড়ে থাকত বছরের পর বছর। সময়ের সঙ্গে চিক চিক করা বালুর আস্তরণ ঢাকা পড়ত প্রাকৃতিকভাবে জš§ নেওয়া কাঁশবন কিংবা ঝাউগাছে। এদিকে যমুনার গ্রাসে বাস্তুভিটা হারানোরা জীবনের ও জীবিকার প্রয়োজনে ঘর বেঁধেছেন নতুন জেগে ওঠা চরে। ধীরে ধীরে চরে বাড়ছে জনবসতির ব্যাপ্তি। তারা চলে ফলাচ্ছেন নানা ফসল।
ভূঞাপুরের চরাঞ্চলে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমিতে এই এলাকার বসবাসকারীরা ধান, পাট, ভুট্টা, মরিচ, গম, মসুর, খেসারি, ছোলা, চীনাবাদাম, মিষ্টি আলু, কেশর, পেঁয়াজ, রসুন, তিল, তিসি, কালোজিরা, আখ ও মাষকলাইসহ নানা ফসল ফলাচ্ছেন। আর এ সব ফসল জেলার চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যান্য: শাড়ি-চমচম-আনারস ছাড়াও এ জেলার দেলদুয়ারের শীতল পাটি, চাদর বা শাল, একই উপজেলার ফাজিলহাটির লেবু অর্থনৈতিক আয়ের একটি বড় অংশ হয়ে যাছে। বিশেষ এ ফাজিলহাটির লেবু এশিয়াসহ ইউরোপের অনেক দেশে রফতানি হচ্ছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী