শিক্ষকতা কোনো চাকরি নয় শিক্ষকতা হলো ব্রত

সুরাইয়া বানু ডলি: কয়েক দিন আগে রাজধানীর পল্টনে আমার এক বন্ধুর অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে বন্ধু আমাকে সবার সঙ্গে আমি একজন শিক্ষক সে কথা বেশ গর্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অনেকের মধ্যে একজন রাজনীতিবিদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পোশাক-আশাকে রাজকীয় ভাব, চেহারায় সরলতা। একজন উচ্ছ্বল যুবক। একটু নড়েচড়ে বসলেন। কিছু আলাপ-চারিতার পর বললেন, আগে ভাবতাম শিক্ষকদের কত সম্মান। রাজনীতি করি, সেই সুবাদে মন্ত্রিপাড়ায় আনাগোনা। সেখানে দেখি শিক্ষকদের কোনো সম্মান নেই। কেউ বসতেও বলেন না। বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এসেছে। মনে মনে বললাম, শুধু মন্ত্রিপাড়া কেন সবখানেই আজ শিক্ষকদের সম্মান ক্ষণ্ন। অথচ শিক্ষকরাই সব পেশার সৃষ্টি করেন। পুলিশ, সেনাসদস্য, রাজনীতিবিদ, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র কিংবা ছাত্রী।

একটি শিশুকে বড় করা মানুষ করার দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষক। শিশু জš§গ্রহণ করেই প্রকৃত মানুষ হয় না। জšে§র পর থেকে শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠে। শিশুকে বড় করার জন্যে আলোর ভুবনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্যে, আলোকিত মানুষ করে গড়ে তোলার জন্যে, আলো মানব প্রয়োজন। এই আলো মানব হলেন শিক্ষক। আলো মানব শিক্ষকই তার অনুসারীদের আলোকিত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারেন। শিক্ষকতা কোনো চাকরি নয়, শিক্ষকতা হলো ব্রত। যিনি শিক্ষাদানের মহান ব্রত নিয়ে কাজ করেন তিনিই শিক্ষক। শিক্ষক তার সারা জীবনের অর্জিত শিক্ষাকে যখন শিক্ষার্থীর মাঝে বিলিয়ে দিতে পারেন তখনই তার শিক্ষকতা জীবনের পূর্ণতা আসে। তিনি শুধু শিক্ষকই হবেন না হবেন সুশিক্ষক। কেননা সুশিক্ষার জন্য চাই সুশিক্ষক, আলোকিত মানুষ গড়ার জন্যে আলো মানব। কঁধহ ঈযঁহম নামে চীন দেশের একজন দার্শনিক বলেছেন-

স্রষ্টা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর মানুষ সৃষ্টি করেছেন সভ্যতা ও সংস্কৃতি। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক। শিক্ষক তার জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য দিয়ে সব কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের মতো ও জ্ঞান দীক্ষা দিতে পারেন। আবহমান বিশ্ববাসীর শিক্ষক সক্রেটিসের জীবনী থেকে এর যথার্থ প্রমাণ মেলে। শিক্ষার আলোয় জনগণের জ্ঞানহীন অন্ধ হƒদয় আলোকিত করার অপরাধে হেমলক পান করে তাকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। মৃত্যুর সময়ও তিনি বলে গেছেন, তোমরা শিক্ষার পথ ধরে এগিয়ে চলো। সে পথ ধরেই তার অনুসারীরা জয় করেছিলেন শিক্ষাকে; আর পরাজিত করেছিলেন ক্ষমতালোভী লোকদের। কিন্তু বর্তমান সমাজে এ ঘটনা বিরল।

একজন রাজনীতিবিদের ক্ষমতা, একজন ধনী ব্যবসায়ীর ক্ষমতা বস্তু জগতে অর্থনৈতিক ক্ষমতার ওপর। কিন্তু শিক্ষকের ক্ষমতা মানুষের হƒদয় জগতের ওপর। একজন গায়ক, একজন কবি, একজন নাট্যশিল্পী যেমন তাদের নৈপুণ্য দিয়ে মানুষের হƒদয়কে আকর্ষণ করেন। একজন শিক্ষক তেমনি তার ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীর মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেন। অহেতুক তর্জন গর্জন শিক্ষার্থীকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে না। মনে রাখতে হবে শিক্ষক ; তৈরি হন।

শিক্ষকের ইংরেজি- শব্দের প্রতিটি অক্ষর শিক্ষকের ইংরেজি গুণের স্বাক্ষর বহন করে। ঊসড়ঃরড়হধষ, জ-জবধফবৎ, কথা বলাটা একটা শিল্প। একজন শিক্ষকের আঞ্চলিকতা পরিহার করে প্রমিত উচ্চারণে সুন্দর করে কথা বলার দক্ষতাও থাকতে হবে। শিক্ষকের কথা হƒদয়গ্রাহী হতে হবে। হƒদয় স্পর্শ না করলে অন্য কোনো পেশায় হয়তো ভালো করা যায় কিন্তু শিক্ষক হওয়া যায় না। একজন শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষক ঐবৎড় বা গড়ফবষ বিশেষ করে বয়োঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীরা মা-বাবা বা পৃথিবীর অন্য যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে শিক্ষকের কথা ও আচরণকে বেশী গুরুত্ব দেয় এবং অনুসরণ করে।শিক্ষকের আচার-ব্যবহার রুচিবোধ, ব্যক্তিত্ব এবং আদর্শ শিক্ষার্থীর কাছে অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয়। শিক্ষকের কাজ হচ্ছে ক্লাসে সবচেয়ে অসহায় শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো। তাকে উৎসাহ দেয়া, সাহায্য করা। সেবার ব্রত নিয়ে একজন নার্স বা ডাক্তার যেমন রোগীর পাশে থাকেন একজন শিক্ষককে তেমনি শিক্ষার্থীর পাশে থাকতে হবে। শিক্ষক হবেন দার্শনিক, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক, শিক্ষার্থী শিক্ষকের মধ্যে ভরসা করার জায়গা খোঁজে, একজন উপকারী মানুষ, একজন বন্ধুকে খোঁজে। একজন শিক্ষক, শিক্ষার্থীর মনের ওপর যতখানি প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন অন্য কোনো নেতা বা ব্যক্তির পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘গায়ের জোরে নেতা হওয়া যায়, সন্ত্রাসীও বটে, কিন্তু গুরু হওয়া যায় না। অনুশীলন ধর্মী এবং আজীবন ছাত্রত্ব থাকার মানসিকতা একজন শিক্ষকের অবশ্যই থাকতে হবে। আজকাল অধিকাংশ শিক্ষকদের মধ্যে পড়াশোনা করার মানসিকতা একেবারে নেই বললেই চলে।

পাঠক্রমের সিলেবাসের বাইরে তারা যেতেই চান না। তারপরেও সব কিছুই চর্বিত চর্বণ। কিন্তু একজন সুশিক্ষককে পর্যাপ্ত অনুশীলন করতে হবে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, একজন শিক্ষক একজন ছাত্র, কিন্তু তিনি একজন আদর্শ ছাত্র, শিক্ষকের মধ্যে যদি জ্ঞান আহরণের আকাক্সক্ষা প্রবলভাবে জ্বলতে না থাকে তিনি কখনও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণে উৎসাহিত করতে পারেন না। শিক্ষক হবেন জলাশয়। তিনি শুধু শিক্ষার্থীর জ্ঞান পিপাসু মনের তৃষ্ণা নিবারকই নন, সু-শিক্ষক জ্ঞানের তৃষ্ণাকে বাড়িয়ে দেন। একজন সু শিক্ষকের ক্লাসে শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শিক্ষকের কথা শোনে। ৪৫ মিনিটের ক্লাস যেন নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। প্রকারান্তরে, এমন অনেক শিক্ষক আছেন যাদের ক্লাস যেন শেষ হতেই চায় না। শিক্ষক যেমন ঘড়ি দেখেন ছাত্রছাত্রীরা তেমনই উসখুস করে। সীমিত জ্ঞান নিয়ে শিক্ষকতা বৃত্তি গ্রহণ করলে তিনি তার বৃত্তিতে কখনও সফল হতে পারবেন না। তার জ্ঞান শুধু যে শিক্ষণীয় বিষয়ে থাকবে তা নয়- জ্ঞানের সব শাখায় তার বিচরণ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে একজন ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় একজন রুগী মারা যান কিন্তু একজন শিক্ষকের দেয়া ভুল শিক্ষায় সমগ্র জাতি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। অপরপক্ষে শিক্ষক যদি অভিভাবকের আস্থাভাজন না হন তবে তিনি কখনও আদর্শ বা সুশিক্ষক হতে পারবেন না।

শিক্ষকের দায়িত্ব হলো সু-শিক্ষার মাধ্যমে স্ব-শিক্ষিত করার পথ দেখিয়ে দেয়া। যিনি বিষয়বস্তু নিজে বোঝেন কিন্তু অন্যকে বোঝাতে পারেননা তার পাঠদান কখনও আনন্দদায়ক হতে পারে না। যে শিক্ষার মধ্যে আনন্দ থাকে না সে শিক্ষা কখনও হƒদয়গ্রাহী হতে পারে না॥ আনন্দ দায়ক শিক্ষা না হলে সফলতাও আসে না। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত শিক্ষক বিবর্তনবাদে দেখতে পাই , গুরু মশাই, পণ্ডিত মশাই, মাস্টার মশাই, স্যার, শিক্ষক মশাই….। শেষের বিবর্তন সংকোচে বলতে পারছি না। তাই প্রতিটি স্তরের শিক্ষক বিবর্তনের মাহাত্ম সবারই জানা আছে। ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় বাদশাহ আলমগীরের শিক্ষকের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শনের যে নিদর্শন দেখেছি তা কোথায় হারিয়ে গেল? তার জন্য দায়ী কারা?
যারা দু‘চারজন সুশিক্ষক আছেন তারা মনে হয় হালচাল দেখে তাজ্জব বনে গেছেন।

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা না বলে পারছি না। শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ভাবতে অবাক লাগলেও সত্যি এটাই যে, অধিকাংশ শিক্ষক এ সময়ে বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। তবে দক্ষতা উন্নয়নের জন্যে নয়। অতি হিসেবী শিক্ষকও মোবাইলে টাকা খরচ করে হলেও সহকর্মীকে প্রশিক্ষণে টাকার অংকটা কত হবে জানতে চান। দক্ষতা উন্নয়নের আকাংখা খুব কম শিক্ষকের মধ্যে থাকে। প্রশিক্ষণ শেষে নির্ধারিত টাকা পেয়ে লব্ধ জ্ঞান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে রেখে কিছু কেনাকাটা করে মহা আনন্দে ফিরে আসেন। আফসোস্ এসব শিক্ষকদের জন্য। এখন প্রশ্ন এসে যায় আমাদের মতো শিক্ষককে যদি কেউ সম্মান না করে তা হলে কাকে দোষ দেব? শিক্ষকের মধ্যে কোনো না কোনো শিক্ষক ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার গুণে ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ ও প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন।

আজ কেন হারিয়ে গেল শিক্ষকদের মর্যাদা? শিক্ষকতাকে অনেকে ব্রত না ভেবে চাকরি হিসেবে নিয়েছেন। তাই সৃষ্টির মধ্যে যে আনন্দ তারা সেটা অনুভব করতে পারেন না। তাদের ছাত্রছাত্রীদের বা অনুসারীদের বোঝাতে পারেন না- অর্জন আর উপার্জনের মধ্যে পার্থক্য, বোঝাতে পারেন না প্রতিযোগিতার নাম জীবন নয়, সহযোগিতার নাম জীবন। বোঝাতে পারেন না মানুষের জীবনে টাকা প্রয়োজন কিন্তু টাকাই সুখের মাপকাঠি নয়। টাকা উপার্জনেরও একটা সীমা থাকা প্রয়োজন। আমরা জানি সভ্যতা এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না। সভ্যতা যাযাবর। পৃথিবীতে এক এক সময় এক এক যুগ এসেছে। যেমন- ধর্মের যুগ, দর্শনের যুগ, শিল্প সাহিত্যের যুগ, টেকনোলজির যুগ। বর্তমানে চলছে বিত্ত-বৈভবের যুগ। ভয়ংকর যুগ। যা সবার কাছে নেশার মতো হয়ে উঠেছে। যে নেশার কোনো শেষ নেই। চাই-চাই আরও চাই। কতটুকু চাই তার কোেেনো সীমানা নেই। উপলব্ধি করার সময় নেই, নির্মল আনন্দ নেই। পৃথিবী এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। আজকের পৃথিবীতে মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হচ্ছে অনেক কিন্তু আত্মিক উন্নতির পথ ক্রমেশই সংকুচিত হয়ে আসছে।তাই মানুষের সম্পদ আছে শান্তি নেই, শক্তি আছে সুখ নেই, বিদ্যা আছে জ্ঞান নেই। আজ সু-শিক্ষকের বড় প্রয়োজন।

শিক্ষকের প্রধান দায়িত্ব ছাত্র-ছাত্রীকে যোগ্য করে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা। নেয়ার চেয়ে দেয়ার আনন্দটা অনেক বেশি একথা তাদের বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষককে হতে হবে ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাইবে’ নীতিতে বলীয়ান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। চীন দেশে একটি প্রবাদ আছে, যদি তুমি এক বছরের ফসল চাও তা হলে একটি কলা গাছ লাগাও। যদি দশ বছরের ফসল চাও তাহলে একটি গাছ লাগাও। আর যদি শত বছরের ফসল চাও তাহলে জনগণকে শিক্ষা দাও। এই শত বছরের ফসল ফলানোর কাজে যিনি নিয়োজিত থাকেন তিনি শিক্ষক। তাই এই পেশায় পদার্পণকারী ব্যক্তিকে অবশ্যই সুন্দর নৈতিকতাপূর্ণ আদর্শ মানুষ হতে হবে। দাম্ভিকতাপূর্ণ তর্জন গর্জন কিংবা রাজনৈতিক মারপ্যাচে কলুষিত ব্যক্তির এ মহান পেশায় দায়িত্ব গ্রহণ সাজে না। যে সব ব্যক্তি এই মহৎ বৃত্তিকে মনে প্রাণে গ্রহণ করবেন তাদেরই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত। বৃত্তিতে আগ্রহ থাকলে শিক্ষক তার শিক্ষাগত অভাব অনেক সময় কাটিয়ে উঠতে পারেন। শিক্ষার্থীর জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধন করতে পারার মধ্যেই শিক্ষক পান পরম তৃপ্তি। অনেকে আরাদ্ধ কাজের সমাপ্তি নিজের জীবনে দেখে যেতে পারেন না।

যে বাদশাহ কুতুব মিনার আরম্ভ করেছিলেন তিনি তার শেষ দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু একজন শিক্ষক এমন সৌভাগ্যবান যে, তিনি তার মিনারের সাফল্য অর্থাৎ শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেন। এটা একজন শিক্ষকের পক্ষে কম সুখের নয়। (চলবে)

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০