শিক্ষকতা পেশার যথাযথ মূল্যায়ন সময়ের দাবি

একটি দেশে শিক্ষক আর্থসামাজিক দিক দিয়ে কতটা মর্যাদাসম্পন্ন, তা দিয়ে দেশটি কতটা সভ্য তা নির্ণয় করা যায়। শিক্ষা হলো জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষক সেই মেরুদণ্ডের মূল চালিকাশক্তি। সব ধর্ম, সম্প্রদায় ও জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিটি নীতিবান শিক্ষক উন্নত সমাজ ও জাতি গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষকদেরই বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকদের দেয়া শিক্ষা থেকেই গড়ে ওঠে প্রজন্মের আদর্শিক মানসিকতা। খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীতে মহান তিন দার্শনিকের দিকে দৃষ্টিপাত করলেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাই। প্লেটো শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক সক্রেটিসকে; আর অ্যারিস্টটল শিষ্যত্ব অর্জন করেছিল প্লেটোর। তাছাড়া উপমহাদেশের বিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা ইকবাল তার প্রথম সাধনার আস্বাদ লাভ করেছিলেন তার শিক্ষক মাওলানা সৈয়দ মীর হাসানের কাছ থেকে। তার সাহচর্যেই ইকবালের প্রতিভার প্রাথমিক বিকাশ সাধিত হয়েছিল। এভাবেই শিক্ষকরা সমাজকে আলোকিত করে হয়ে ওঠেন সমাজের আলোকবর্তিকা।

শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদের সম্মানার্থে ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবরের ৫ তারিখে বিশ্বব্যাপী বিশ্ব শিক্ষক দিবস প্রায় ১০০টি দেশে উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে এ উপলক্ষে এবছরও ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর: শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দিবসটি পালিত হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় শিক্ষকের মর্যাদা শীর্ষক অনবদ্য সব কলাম। কিন্তু বাস্তবে কি শিক্ষকের প্রকৃত মর্যাদা বাংলাদেশ দিতে পেরেছে? দেশে চাহিদার শীর্ষে কি শিক্ষকতা পেশা আবেদন রাখতে পারছে? অন্যান্য পেশার সঙ্গে তুলনা করলে মেধাবী তরুণদের মাঝে শিক্ষকতা পেশা বাংলাদেশে চাহিদার মধ্য পর্যায়েও নেই। বহির্বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে শিক্ষকদের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা, সামাজিক মূল্যায়ন ও অন্যন্য সুযোগ-সুবিধা নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জ দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি আলাদা দুটি খাত।

পুরোদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৭ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি। অর্থাৎ জাতির উন্নতি ও বিকাশের সিংহভাগ গতিধারা বেসরকারি বিদ্যালয়গুলো ধারণ করে থাকে। সরকারি-বেসরকারি উভয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় একই শিক্ষাব্যবস্থা ও কারিকুলামের অধীনে। অথচ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সব দিক দিয়ে বৈষম্য ও অসাম্যের আধিক্য। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষকদের এমন করুণভাবে মূল্যায়ন করা হয়, যেন জাতি ও দেশ গঠনে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। বিখ্যাত মনীষী ইবনে খালদুন তার আল মুকাদ্দিমা গ্রন্থে বলেছিলেন, শিক্ষকও একজন মানুষ। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো শিক্ষকেরও ব্যক্তিগত জীবনধারনের উপকরণের প্রয়োজন আছে। তিনি যদি বর্তমানে বেঁচে থাকতেন এবং বাংলাদেশের শিক্ষকদের আর্থসামাজিক অবস্থা দেখতেন, তবে হয়তো বলতেন, সরকারি শিক্ষকদের মতো বেসরকারি শিক্ষকরাও শিক্ষক এবং তারাও সমমর্যাদা প্রাপ্তির অধিকার রাখে। দেশের বৃহৎ শিক্ষকসমাজকে এভাবে উপেক্ষিত, অবহেলিত এবং তাদেরকে হীনম্মন্যতায় রেখে কখনও একটি দেশ এগিয়ে যেতে পারে না।

ভার্কি ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর সমাজকাঠামোয়, বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের বৃহৎ সম্মানের চোখে দেখা হয়। চীনে এক অভিজ্ঞ শিক্ষককে ডক্টর উপাধিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মান বিবেচনা করা হয়। জাপানে শিক্ষকতা খুবই জনপ্রিয় একটি পেশা। সেখাুনে শিক্ষকদের বেতন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের তুলনায় অধিক। গবেষণায় দেখা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এখনও পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষক হতে উৎসাহিত করে। শিক্ষকদের যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়, তখন শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদাও অধিকতর বৃদ্ধি পায়। দেশের তখন সবচেয়ে মেধাবী, সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণদের প্রধান পছন্দ হয় শিক্ষকতা পেশা। ফলে অযোগ্য ও নীতিহীন শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষকতা পেশা কলুষিত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। বাংলাদেশে পূর্ববর্তী সরকারের পতনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের যে বেহাল দশা পরিলক্ষিত হয়েছে, তাতে এ দেশে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই শিক্ষকদের আর্থসামাজিক অবনতি ও সম্মানহীনতার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

এর পিছনে কিছু শিক্ষকদেরও দায় ছিল না, কথাটি যেমন ভুল, তেমনি শিক্ষক হিসেবে তাদের সম্মান এভাবে পদদলিত হওয়াটাও অপ্রত্যাশিত এবং অস্বাভাবিক। কোনো শিক্ষকের যেমন সমাজের সবচেয়ে নীতিবান, সৎ, দক্ষ, রুচিশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হওয়া বাঞ্ছনীয়, তেমনি সমাজের আর প্রতিটি স্তরের মানুষের শিক্ষকের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা সমুন্নত করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া কর্তব্য। বাংলাদেশে একটি পরিকল্পিত শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে, শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্যের পরিপুষ্টি সাধন করতে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বাস্তবসম্মত ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলে শিক্ষকদের জন্য বৈষম্যহীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনধারণের পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের প্রতি জাতির অপরিশোধ্য ঋণের কৃতজ্ঞতা প্রকাশারার্থে এখনই সর্বব্যাপী ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০