Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 12:39 am

শিক্ষক নির্যাতন জাতির জন্য অশনিসংকেত

সাধন সরকার: মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা বর্তমানে কতটা অসহায়, তা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। শিক্ষককে অপমান, নির্যাতন করার মতো ঘটনা মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষককে অপমান ও অপদস্থ করা এবং তার গায়ে হাত তোলার মতো ধৃষ্টতার ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। এ সমাজে যত ধরনের পেশা আছে, তার মধ্যে তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক, আদর্শপরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ পেশা হলো শিক্ষকতা। শিক্ষক ও শিক্ষকতার প্রতি আঘাতের ঘটনায় এ সমাজ কখনও চুপ করে থাকেনি। সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে কেন তারই শিক্ষার্থীর হাতে মরতে হবে? নড়াইলের সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে কেন গলায় জুতার মালা পরতে হবে? মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হƒদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্র করে ভুল বোঝাবুঝির জেরে শিক্ষককে কেন জেলে যেতে হবে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকাকে কেন ক্লাসে হেনস্তা হতে হবে? কেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দপ্তরির হাতে মার খেতে হবে?

সুনাগরিক হওয়ার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে সবাই যে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করছে, তা কিন্তু নয়। অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও ঘুষ-দুর্নীতি-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। আবার শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের জন্য লেখাপড়া করছে, নাকি শুধু পাসের জন্য তথা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিখছে, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ‘শিক্ষক’ সে তো সবার ওপরে। বাবা-মায়ের পরই শিক্ষকের স্থান। ‘শিক্ষক’ শব্দটা শ্রদ্ধায় মাথা নত হওয়া ভালোবাসাময়, বন্ধুত্বপূর্ণ, ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ, আদর্শপরায়ণ ও সম্মানজনক ব্যক্তিকেই বোঝায়। অনেককেই দেখেছি শুধু সম্মানের জন্য অন্য সব লোভনীয় চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতা পেশায় আসতে। কখনও কি চিন্তা করে দেখেছি, একজন শিক্ষককে যখন জুতার মালা পরিয়ে দেয়া হয়, তখন সেই শিক্ষকের মনের অবস্থা কেমন হয়? চরম অপমানিত হলে আর কী অবশিষ্ট থাকে একজন শিক্ষকের জন্য! অন্য দেশের তুলনায় বেতন কম পেয়েও একজন শিক্ষক শুধু সম্মানটুকু পেয়ে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছেন। সেই সম্মানটুকু নিয়ে যদি টানাটানি করা হয়, তাহলে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ হারাবে মেধাবীরা। কেন জানি মনে হয় শিক্ষক হলো সবচেয়ে ভদ্র, বিনয়ী ও নিরীহ প্রাণী! ঠিক এ কারণেই সহজেই তাকে আঘাত করা যায়, সহজেই অপমান করা যায়!  এই সমাজে ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেন শিক্ষককে জীবন দিতে হবে? নড়াইলে, সাভারে ও মুন্সীগঞ্জের ওই শিক্ষকদেরই শুধু অপমান ও অপদস্থ করা হয়নি, অপমান করা হয়েছে পুরো শিক্ষক সমাজকে। কেন বেছে বেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের প্রতি হামলা করা হচ্ছে? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের এখনই চিহ্নিত করতে হবে।

কেন জানি মনে হয়, পাঠ্যবইয়ের পড়ার সঙ্গে বাস্তব জীবনের মিল কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! সমাজে অবক্ষয় চলছে! দেখা যাচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল দিয়েও এ সমাজে পার পাওয়া যায়। বাজারে কারসাজি করে, সিন্ডিকেট করে নিজের স্বার্থ হাসিল করা যায়। ট্রাফিক আইন অমান্য করলেও জরিমানা হয় না! ক্ষমতার জোরে চাঁদাবাজি করেও অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। সামান্য বেতনে চাকরি করেও আজ অনেকে বাড়ি-গাড়ির মালিক। শুধু দালালি করেও অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত! টাকা পাচার, ঘুষ-দুর্নীতি করে বিদেশে সেকেন্ড হোম করলে সমাজে সস্তা সম্মান পাওয়া যায়। অনিয়ম ও চুরি করলেও ‘বড় ভাই-মামার’ জোরে পার পাওয়া যায়! চারপাশের সস্তা ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের নামে দম্ভ করা যায়। শুধু বস্তুগত উন্নয়ন নয়, মন-মানসিকতায় উন্নতি না হলে সে জাতির ভিত্তি দৃঢ় হয় না। মিথ্যাকে মিথ্যা আর সত্যকে সত্য বলতে হবে। শিক্ষার্থীরা এখন একটু হলেও ব্যস্ত, অসহিষ্ণু ও ধৈর্যহীন! বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অনুশাসনের দিকটা কিছুটা হলেও কমে গেছে! সমাজে চলছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। এখন শিক্ষার্থীরা যন্ত্রের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে বেশি। মোবাইলটাই যেন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম! পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে! একটা সময় ছিল, শিক্ষককে মানা হতো সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে। শিক্ষককে দেখলে শিক্ষার্থীর মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেত। কোথায় গেল সে সম্মান? যে বা যারা শিক্ষককে অপমান করছে, তারা এর আগেও ছোটখাটো অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে, তা না হলে শিক্ষককে অপমান করতে তারা সাহস পেত না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে স্নেহ-শ্রদ্ধার, আন্তরিকতার ও বন্ধুত্বের। শিক্ষক সমাজকে একের পর এক অপমান করা জাতির জন্য অশনিসংকেত। দু-একজন অপরাধীকে শাস্তি দিলেও যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এমনটি নয়, সামগ্রিকভাবে সামাজিক পরিবর্তন দরকার। শিক্ষক সমাজকে অপমান ও হেনস্তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

শিক্ষক

লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়

মুন্সীগঞ্জ