Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 8:26 am

শিক্ষাকে শ্রমবাজারের উপযোগী করে তুলতে হবে

তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল: পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা। ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছি। মেজাজটাও অনেক ভালো, বাড়ি যাওয়া মানে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। কাজের চাপ নেই। রাত করে বাড়ি ফিরো। পুরো সকালটা ঘুমাও, কতই না শান্তি! মনের সতেজতার আমেজ শরীরেও ছড়িয়ে  গেছে। ভাবলাম, একটু হাঁটাচলা করে আসি! আমার মতো চাখোরদের ভেতরটা সবসময় চা-চা করে। তাই হাঁটব কিন্তু ট্রেনের খাবারের বগিতে যাব না, তা কি হয়! চা পান করতে গিয়েই বিপত্তি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। রাজ্যের চিন্তা এলো মাথায়! ঘটনার নায়ক এম ইসলাম (ছদ্মনাম)। নামটা জানতে চাইলেই বলেছিলেন, কিন্তু ইংরেজিতে ‘মাই নেম ইজ মিস্টার এম ইসলাম।’ খটকা লেগেছিল, নিজের নামের আগে মিস্টার বলেছিলেন।

বেশ কটি বগি পেরিয়ে খাবারের বগিতে যাই। এক পেয়ালা চা চাইলাম। দেখি এক পরিপাটি ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে আছেন। রাতে ভ্রমণকালে নেহাত পদস্থ লোক ছাড়া কেউ সচরাচর এত পরিপাটি থাকে না। কিঞ্চিৎ কৌত‚হলবশত ভদ্রলোককে যখন হাই বললাম, ঠিক তখন থেকে তার নাম না বলা পর্যন্ত এক ঘণ্টা তার বাক্যবাণ আমি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলাম। তার ইংরেজি শব্দের উচ্চারণ, বাচনভঙ্গিতে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। তিনি গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাট যাচ্ছেন অনেক দিন পর। ঘরছাড়া প্রায় দুই যুগ, ঢাকায়  একটি বহুজাতিক কোম্পানির সিইও।

কৌত‚হল আরও বাড়ল আমার, এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি জানালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন। বাসা ধানমণ্ডিতে। দুই সন্তান, একদম সুখী পরিবার, বসুন্ধরায় জায়গা কিনেছেন ইত্যাদি।

আমি তার সফলতার গল্প শুনছি। একটু খারাপও লাগছিল, একবারও আমার পরিচয় জানতে চাইলেন না। আমি একপ্রকার জোর করে আমার নামটা তাকে জানালাম। তারপর তার নাম জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘মাই নেম ইজ মিস্টার এম ইসলাম।’ আমি তো হতভম্ব, নিজের নামের আগে মিস্টার বলে নাকি কেউ! ভদ্রলোক হুট করে চা পানের নিমন্ত্রণ জানিয়ে দুটি চায়ের অর্ডার দিলেন। কিন্তু তার কথায় বুফেকারের লোকটি গুরুত্ব দিল না। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘ভাই, উনি চায়ের অর্ডার দিয়েছেন, আর আপনারা তো খাবার বিক্রি করতেই এখানে কাজ করছেন।’ লোকটি আমাকে উল্টো প্রশ্ন করল, ‘আপনি টাকা দেবেন?’। এতে ক্ষেপে গেলেন মি. এম ইসলাম।  ইংরেজিতে যত গালি আছে দেওয়া শুরু করলেন।  আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বুফেকারের লোকের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। এক লোক দৌড়ে এসে ভদ্রলোককে টেনে নিয়ে গেল পাশের কামরার দিকে। তারপর যে লোকটি এম ইসলামকে নিয়ে গেল, তাকে রেখে এসে বুফেকারের ম্যানেজারকে বিল শোধ করলেন। পরে বুফেকারের লোকের কাছে জানলাম, এম ইসলাম চার ঘণ্টায় ৩২ কাপ চা খেয়েছে। যে লোকটি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, তিনি এসে আর চা না দিতে বারণ করে গেছেন এবং সাবধান করে গেছেন যে, মি. এম ইসলামের মাথায় নাকি সমস্যা আছে।

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। এক ঘণ্টার আলাপে মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি মস্তিষ্কের ভারসাম্যহীনতায় ভুগছেন তিনি। এবার আমার কৌত‚হল আরও বেড়ে গেল। এম ইসলামের সঙ্গের লোকের দিকে হাত বাড়িয়ে পরিচয় দিলাম। জানতে চাইলাম, উনার সমস্যাটা কী? তিনি জানালেন, এম ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন।  কিন্তু চাকরি, বাড়ি, পরিবার-সংক্রান্ত তথ্য সত্য নয়। এত মেধাবী হয়েও ভালো চাকরি পাননি। এমনকি বিসিএসে কয়েকবার ভাইভা পর্যন্ত গিয়ে কিছু হয়নি। চাকরি না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ১০ বছর আগে তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিন মাস অন্তর ঢাকার এক বড় নিউরোলজিস্টের কাছে আনতে হচ্ছে। কিন্তু নিরাময় হচ্ছে না। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পেয়েছিলেন। অসুখের বিষয় টের পেয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে ছাঁটাই করে।

মনটাই খারাপ হলে গেল। আফসোস হলো, কেন যে বাসে গেলাম না। ভদ্রলোক আমার হƒদয়ে বড় একটা নাড়া দিলেন। সারারাত তাকে আর তার বেকারত্ব নিয়েই ভেবে গেলাম। আমিও যে একসময় বেকার ছিলাম। সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশে কমবেশি সবাই একটা সময় কিছুদিনের জন্য বেকার থাকেন। কেউ স্বল্প সময়ের জন্য আর এম ইসলামরা আমরণ বেকার থাকেন, যেন বেকারত্বের অমরত্ব।

মা-বাবার শেষ সম্বলটুকু দিয়ে যারা লেখাপড়া করেছে, কিংবা যে মেধাবী যুবক দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছে, যার বাড়িতে চার-পাঁচটি ছোট ভাইবোন এখনও স্কুল-কলেজে পড়ছে আর মা-বাবা তাকিয়ে আছেন তার দিকে, কবে সে চাকরি পাবে, আর সংসারের হাল ধরবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৫-১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। বিবিএসের তথ্যমতে, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি, ৯ শতাংশ। এর মানে স্নাতক কিংবা এর বেশি ডিগ্রিধারী প্রতি ১০০ জনে ৯ জন বেকার। তাহলে কি এদেশে পড়াশোনা না করলেই কাজ পাওয়ার সুযোগ বেশি? কোনো ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাননি, এমন মানুষের মধ্যে মাত্র ২.২ শতাংশ বেকার। ১৫-২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ১০ শতাংশে বেশি বেকার।

সময় এসেছে চিন্তা করার, এভাবে বেকারত্ব বাড়তে থাকলে চরম বিপর্যয়ে ধাবিত হবে, যুবসমাজ বিপথে পরিচালিত হবে, অপমৃত্যু, নেশাগ্রস্ত হওয়া, অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলবে। একে তো প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজার, তার ওপর বিষফোঁড়া হয়ে আছে অনৈতিক লেনদেন। তিন থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সোনার হরিণ চাকরি। যার অর্থ আছে, সে চাকরি বাগিয়ে নিচ্ছে।

বেকারত্ব কি তাহলে বাড়তেই থাকবে? কিছুই কি হবে না? যে শিক্ষা শ্রমবাজারে কোনো অবদান রাখে না, সে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে পরিকল্পনা নিতে হবে। আউট সোর্সিংয়ের কাজের বিষয়ে যুবসমাজকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা নিন। কোনো কাজই ছোট নয়। মাস্টার্স পাস তরুণ ট্যাক্সি চালাচ্ছে, এটি দোষের কিছু নয়; কেউ যেন তাকে ছোট করে না দেখে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ইন্টার্নশিপের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। উদ্যোক্তাদের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে চাকরির ক্ষেত্র তৈরির ক্ষেত্রে কিছু বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্মল বিজিনেস কিংবা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজের (এসএমই) জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং নামমাত্র লভ্যাংশে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। একটি টেকনোলজিক্যাল প্ল্যাটফর্ম করা যায়, যা এসএমই’র জন্য টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেবে। মনে রাখতে হবে, বেকারত্বের অমরত্ব সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়। সবচেয়ে বড় কথা, চাকরির পেছনে না ছুটে কিংবা সম্পত্তি বিক্রি করে বিদেশ পাড়ি না দিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে যুবসমাজকে। চাকরি না পেয়ে কেউ মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার জন্য তার দুর্বল চিত্ত নয়, সমাজের মানসিকতাও দায়ী। উচ্চশিক্ষিত হলেই চাকরি করতে হবে, এমন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

মানবসম্পদ  প্রশিক্ষক

chanchal.songÑgmail.com