শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস: শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ

ইয়াছিন আরাফাত: শিক্ষা একটি জাতির উন্নতি, অগ্রগতি ও সফলতার চাবিকাঠি। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর। দেশের এই কারিগরদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার একমাত্র প্রধান কেন্দ্র হলো শিক্ষাঙ্গন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, আমাদের শিক্ষাঙ্গন আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে সন্ত্রাস অন্যতম। দেশের অধিকাংশ ছোট-বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সন্ত্রাসীদের কবলে শোষণ ও শোষিত হয়ে যাচ্ছে। বলপ্রয়োগ, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তার এবং প্রতিষ্ঠার সহজ পন্থার নাম সন্ত্রাস। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী ও প্রতিষ্ঠালাভের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা পেশিশক্তির জোরে, অস্ত্র প্রদর্শন করে ছাত্র-ছাত্রীর মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। সন্ত্রাসীদের মূলমন্ত্র হলো ‘গরমযঃ রং ৎরমযঃ’, অর্থাৎ জোর যার মুল্লুক তার।

সন্ত্রাস শিক্ষাঙ্গনকে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় বড় কলেজগুলোকে তাদের বাপ-দাদার বসতভিটেবাড়ি মনে করে জোর জবর দখল করে নিয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে সবসময় এখন অস্ত্রের ঝনঝনানি লেগেই আছে। সন্ত্রাসকবলিত শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অস্ত্রের অবাদ ব্যবহার, মজুত দেখলে সেগুলোকে রণক্ষেত্র বা ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া কিছুই বলা যায় না। ফলে গ্রাম-মহল্লা থেকে উঠে আসা সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা জীবনের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি অভিভাবকরাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিন পার করছে। এতে শিক্ষাকার্যক্রম অচল হওয়ারই উপক্রম হচ্ছে। শিক্ষা অঙ্গনে যেসব করণে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে, নিম্নে তা সংক্ষেপে আলোকপাত করছি

ক. নোংরা রাজনীতি : একসময় বাংলাদেশের ছাত্র-রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল, যা ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ’৬৬ গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা অর্জন নামে পরিচিত। এসব আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে দেশের ছাত্ররা। উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের চেষ্টা। কিন্তু বর্তমান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজনীতির মাঠ কাঁপাচ্ছে নিজের পেট পূজারীর জন্য। এক্ষেত্রে সিনিয়র জুনিয়র কেউই কাউকে তোয়াক্কা না করে, প্রত্যেকেই ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে, নিজের মায়ের পেটের আপন ভাইকেও হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না, যা আজ রাজনীতিকে ডাস্টবিনের নোংরায় রূপ দিয়েছে। ক্ষমতার চেয়ার চিরস্থায়ী করতে নির্লজ্জভাবে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারীধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গুম-খুন ইত্যাদিতে।

খ. অর্থনৈতিক টানাপড়েন: এ দেশের অধিকাংশ পিতার পক্ষে তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার সব উপকরণ সরবরাহ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এদিকে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাসে সিট-বাণিজ্য, মারামারি, হুমকি-ধমকি অহরহ করে যাচ্ছে, ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও কাজ বেশ তৎপর হচ্ছে। ফলে সাময়িক সুবিধায় লাভের জন্য কিংবা অর্থকড়ির লোভে ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি গ্রহণ করেই ক্যাম্পাস- জীবন উপভোগ করছে। গ্রাম থেকে ওঠে আসা অসহায় গরিব ছেলেটা যখন টাকার অভাবে নিজের পড়াশোনা চালাতে ব্যর্থ হয়, তখনই সে নিজেকে  জড়িয়ে ফেলে সামাজিক অনেক অপকর্মে। মেয়েকেন্দ্রিক অবৈধ রিলেশন, মাদকাসক্ত, শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসী হয়ে দেশ জাতির সর্বনাশ করে অথবা খুন করে বা খুন হয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসে দরিদ্র পিতার কোলে। যার দৃষ্টান্ত আছে ভূরি ভূরি। সাম্প্রতিক ইডেন মহিলা কলেজ, বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা এবং গত সপ্তাহে ফারদিন হত্যা জাতীয় জীবনে এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এসব অন্যায় অপরাধকারীরা সাময়িক কিছু ফায়দা ফেলেও যুগ যুগ ধরে এর গ্লানি তাদেরই টানতে হয়। বিশেষ করে আবরার ফাহাদের হত্যার সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা জীবনের সব কূল হারিয়ে এখন অন্ধকার কারাগারে ফাঁসির প্রহর গুনছে, যা এই জাতির মেধাবীদের জন্য অভিশাপ।

গ. আইনশৃঙ্খলার অবনতি: আইনশৃঙ্খলার অবনতির সুযোগেই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বারবার মাথা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ‘প্রশাসন’ রাজনৈতিক নেতাদের ভয়ে নিজেদের চাকরি হারানোর আতঙ্কে অনেক সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের দলীয় পরিচয় না খোঁজে যথাযথ আইনের দ্বারস্থ করানো, শাস্তির পরিমাণ অপরাধ অনুপাতে নিশ্চিত করানো। এর বিপরীতে শিক্ষাঙ্গনে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। সন্ত্রাসীরা সুযোগ নেয় আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীসহ, শিক্ষক, কর্মচারীরা, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রভিসি এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও তাদের জানমালের নিরাপত্তা হারায়। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ক্যাডার বাহিনী নানা ধরনের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, গুম-খুনের ধ্বংসলীলা প্রকাশ্য দিবালোকে চালিয়ে যাচ্ছে। উপযুক্ত চাঁদা না পেয়ে ব্যর্থ হলে শিক্ষাঙ্গনের চেয়ার, টেবিল ভাঙচুর থেকে শুরু করে, ভিসির বাসভবন অবরোধ করার ও দুঃসাহস প্রদর্শন করে, যা খুবই ধিক্কারজনক। এক্ষেত্রে প্রশাসনের চুপ থাকাটাই একমাত্র দায়ী বলে মনে করছি। ইদানীংকালে দেশে এইরকম পরিস্থিতিও দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা নিজেরাই অনুমতি দিয়ে সরাসরি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা করে এবং ক্যাম্পাস পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে, যা খুবই দুঃখজনক, এই জাতির ধারক বাহকদের জন্য।

ঘ. প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার: শিক্ষাঙ্গনগুলো হওয়ার কথা ছিল বড়রা ছোটদের কাছে, ছোটদের পিতা বা বড় ভাইয়ের সমান শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হিসেবে, আর ছোটরা বড়দের কাছে তাদেরই আপন ছোট ভাইয়ের সমান স্নেহের পাত্র হিসেবে। কিন্তু তা না হয়ে বড় ভাইয়েরা, ছোটদের মশা-মাছির মতো জ্ঞান না করেই দিন পার করছে, নতুন ছাত্রদের রের্গিং করা থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব ইস্যুতে মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে কার্যসিদ্ধি উদ্ধার করেই চলছে। এর মাধ্যমে একে অন্যের ওপর তার নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করে। তখন জুনিয়রদের কাছে সিনিয়ররা অভিশাপের বস্তুতে রূপান্তরিত হয়। তাছাড়া যখনই পদ-পদবি বিতরণ করা হয়, তখন আবার ছোটদের কাছে টেনে নিলেও, পদ-পদবি পাওয়ার পরে মোটেও ওই কাছে টেনে নেয়াটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আর যখন অনুকূল পরিবেশ পায় তখন অস্ত্র ও শক্তি দিয়ে আধিপত্য ক্ষমতা বিস্তারের জন্য খুব মরিয়া হয়ে ওঠে। অবৈধভাবে চাঁদা আদায়ে প্রতিযোগিতা ও প্রভাব সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ফলে সৃষ্টি হয় সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা। লেখাপড়া তখন আপন থেকে পর হয়ে যায়। দেশের মেধাবীরা এভাবেই কালের আবর্তনে একসময়ে হারিয়ে যায়।

ঙ. নৈতিক শিক্ষার অভাব : দেশে বর্তমানে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বালাই নেই। ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কোনো সঠিক অনুশীলন ও গাইডলাইনও নেই। ফলে মানবতাবোধ, মনুষ্যত্ববোধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিয়েছে এবং সে স্থান দখল করেছে সন্ত্রাস। উদাহরণস্বরূপ নৈতিক শিক্ষাবান ছাত্র আর অনৈতিক শিক্ষাবান ছাত্রের মাঝে পার্থক্য।

শিক্ষা হলো একটি ধারালো ছুরির সদৃশ্য, এই ধারালো ছুরি যদি একজন ডাক্তার ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি চিকিৎসা করে রোগীর জীবন সতেজ করে, ঠিক অনুরূপ একই ছুরি যদি একজন সন্ত্রাসের হাতে থাকে তাহলে তিনি মানুষের প্রাণনাশ করেন। তেমনি শিক্ষা যদি একজন সচ্চরিত্রবান ছাত্র গ্রহণ করে, তাহলে সে দেশ ও জাতির কল্যাণ বয়ে আনে, অন্যদিকে যদি একজন দুশ্চরিত্রবান ছাত্র গ্রহণ করে তাহলে সে দুর্নীতি, লুটপাট, ছিনতাই রাহাজানি, অর্থ পাচার করে। তাই আজ নৈতিক শিক্ষার অভাবে পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা, দয়া-মায়ার অপমৃত্যু ঘটেছে।

সর্বোপরি, বলা যায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অবাস্তব ও অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থারই প্রমাণ কিংবা দায়ভার। দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতেই হবে। এক্ষেত্রে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি কঠিন শাস্তি এবং নিষিদ্ধ করার যুতসই উদ্যোগও নিতে হবে।

শিক্ষার্থী

আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০