প্রাণঘাতী মহামারি কভিডের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু এতে কভিড পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হয়ে তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং সেটি কমার সম্ভাবনা আপাতত নেই বললেই চলে। এ কারণে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংগঠন ইউনিসেফ থেকে বারবার বিশ্বের সরকারগুলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ না করার আহ্বানও তাদের পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে।
সারাবিশ্বে কভিডের সংক্রমণে নতুন করে ঊর্ধ্বগতি থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রেখে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায় শিক্ষার্থীর তুলনায় যে অবকাঠামো রয়েছে, সেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অনেকটাই কঠিন। তাছাড়া সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের মতামত মেনেই শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা ভেবে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের ঘরের মধ্যে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বাদে সবকিছুই খোলা। আবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সরকারের কড়া নির্দেশনা থাকলেও তা মানতে সব ক্ষেত্রেই অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও তাই এ সময়ে বাণিজ্যমেলায় যাচ্ছে, মার্কেটে যাচ্ছে, পার্কে যাচ্ছে, খেলার জন্য মাঠে যাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বাইরে গিয়ে আবার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিশছে। তাই এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো অনেকটাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার বিষয়ে সারাদেশের জন্য অভিন্ন সিদ্ধান্ত শহর, গ্রাম এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে অফলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ থাকলেও অনলাইনে ক্লাস চলছে। কিন্তু শহরের অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এবং গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় তারা সেটিতে যুক্ত হতে পারছে না। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে তাদের শিক্ষার্থীদের সেশনজট থেকে মুক্ত রাখতে পারলেও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। তাই তাদের মধ্যে একধরনের হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
দেশে সার্স ভাইরাস সংক্রমণের হার এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও দেশের সব জায়গায় পরিস্থিতি একই রকম নয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুরসহ বড় বড় শহরে করোনা সংক্রমণের হার বেশি হলেও ছোট শহরগুলোয় এই হার অনেকটাই কম। গ্রাম আর শহরের পরিস্থিতির মধ্যেও রয়েছে অনেক ব্যবধান। তাই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একই নিয়ম সবাইকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলবে, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে বন্ধ রাখাও কোনো সমাধান হতে পারে না। এক্ষেত্রে সম্ভব হলে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যেতে পারে। আর সেটা যদি সম্ভব না হলে বিশেষ করে গ্রামের স্কুলগুলো খুলে দেয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা যেভাবে বাইরে অনিরাপদ অবস্থায় ঘোরাফেরা করছে, তার চেয়ে শ্রেণিকক্ষ তাদের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আবার সংক্রমণের হার বিবেচনা করে যেসব শহরের বাসিন্দাদের সংক্রমণের হার বেশি, সেখানে স্কুলগুলোয় যাতে আরও বেশ কিছুদিন অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দিনে দুই-তিন শিফটের মাধ্যমে ক্লাস নেয়া যেতে পারে। শহরের বিদ্যালয়পড়ুয়া সব পরিবারের ছেলেমেয়েদের অনলাইনে ক্লাস করার সক্ষমতা নেই। তাই তাদের সরকার কর্তৃক অনলাইন ক্লাস করার জন্য ব্যবস্থা করে দিতে হবে এবং চলামান টিকা কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে সব শিক্ষার্থীকে ক্লাসে ফেরাতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় আমাদের শিশুদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কভিড মহামারির প্রথম সংক্রমণের সময় দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখার ফলে যত শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ে তার সিংহভাগই গ্রামের শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যাপীঠে ফেরানো না গেলে এই ধারা আবার শুরু হতে পারে। একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই হলো সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাই তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আপন নীড়ে ফেরানো দরকার। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার খোলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আবারও সশরীরে পড়ালেখা শুরু করতে পারবেÑএ প্রত্যাশা সবার।
রুবাইয়াদ ইসলাম
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর