মোহাম্মদ ইয়াছিন: বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা প্রদানে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত চলমান। আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ, জামায়াতে ইসলামীর ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিস, জাতীয় ছাত্র সমাজ ইত্যাদি ছাত্র সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান। যে দল ক্ষমতায় থাকে ক্ষমতাসীন দলের যেকোনো স্বার্থ পূরণে সে দলের ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করা হয়। তখন ছাত্রদের দ্বারা গঠিত অপরাধ অভিভাবক সমক্ষমতাসীন দলের কাছে দুধ-ভাত মনে হয়। কারণ কুকুর ছানা বিড়ালকে নয় বরং কুকুরকেই বাবা সম্বোধন করে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে অর্থাৎ ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, সর্বশেষ ২৪’র গণ-অভ্যুত্থান বা দেশের সংকটকালীন সময়ে ছাত্ররা ছিল জাগ্রত হাতিয়ার। জাতির স্বার্থে অকুতোভয় ছাত্ররা বরাবরই নিয়মিত ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বের আর পরের ছাত্র রাজনীতি মধ্যে আকাশ-জমিন পার্থক্য রয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পূর্বে ছাত্ররা দেশের স্বার্থে ব্যর্থহীনভাবে রাজনীতি করলেও, স্বাধীন হওয়ার পর নিজের স্বার্থের জন্য ছাত্ররাজনীতি করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র নেতা রাজনীতির স্বার্থ হাসিল করার জন্য বছরের পর বছর একই বর্ষে অধ্যয়ন করে। শুরু হয় ড্রপ দেয়া। হলগুলো পরিণত হয় ক্যাডার বাহিনী তৈরির কারখানা হিসেবে। তাদের মূল উদ্দেশ্য রাজনীতির মাধ্যমে টাকা উপার্জন করে জীবনের প্রান্তিক গতি নির্ধারণ করা। হলের গেস্ট রুমগুলো পরিণত হয় আয়নাঘর হিসেবে।
গেস্ট রুমে চালায় অমানবিক নির্যাতন, দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের অশ্লীল শব্দোচ্চারণ আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ থেকে শুরু করে শরীরে আঘাত করা তাদের নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। সাধারণ শিক্ষার্থীরা শুধু মাথা গোঁজার একটা সিটের জন্য দিনের পর দিন অসহনীয় নিপীড়ন সহ্য করে যায়।
ছাত্ররাজনীতি করার সুবাদে ছাত্র নেতাদের সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব বেশি ভূমিকা রাখে। এই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে চাঁদাবাজি করা, হলের ক্যান্টিনে ফ্রি খাওয়া-দাওয়া করা, শিক্ষকদের সঙ্গে সুস্পর্কের দরুন সিজিপিএ ভালো হওয়া, হল প্রশাসনের চোখে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাদে সিট বাণিজ্য, চার বেডের রুম একা দখল নিয়ে রাজত্ব করা, প্রতি রাতে রুমে অনুচরদের নিয়ে গাঁজার আসর বসানো থেকে সব নীতি বিসর্জন কাজে বর্তমান ছাত্ররাজনীতির কর্মীরা জড়িত। এমন ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উন্নয়ন সাধিত হবে?
আবার নতুন পরিবেশে ছাত্র নেতা কর্তৃক অযাচিত আচরণ নবীন শিক্ষার্থীর আশাকে মাঝপথে রুদ্ধ করে দেয়। তাদের সঙ্গে জুনিয়রদের সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য পরিচয় পর্বের নামে র?্যাগিংয়ের শিকার হন নবীন শিক্ষার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেয়া থেকে শুরু করে নাচতে বাধ্য করা, গান গাওয়া, কবিতা আবৃত্তি, গাছে উঠানো, কান ধরে উঠবস করানো, অশালীন ভাষায় বকাবকি করা, অকট পরিস্থিতিতে হাসানোর চেষ্টা করা ইত্যাদি অপসংস্কৃতির শিকার হন নবীনরা। প্রভু-ভৃত্য আচরণের সম্পর্কের ন্যায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে তাদের মধ্যে। প্রায় সময় দেখা যায় নবীনরা ভীত হয়ে পরিচয় পর্বে তাদের অভিভাবকদের নিয়ে আসে। এমতাবস্থায় কেউবা ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দিন থেকে দিন র?্যাগিংয়ের হার বাড়ছে। অনেকে কলুষিত ছাত্ররাজনীতির ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয় না।
বর্তমান সময়ে দেখা যায়Ñদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতাদের হল রুম থেকে পিস্তল, রামদা, হকিস্টিক, হাতুড়ি, রড, মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করছে প্রশাসন। সুষ্ঠু আর আদর্শ রাজনীতি চর্চাই যদি ছাত্রদের উদ্দেশ্য থাকে তাহলে হল রুম ভর্তি অস্ত্র কেন? ছাত্ররাজনীতির প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে প্রাণ গেছে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের। তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ অন্যতম। এছাড়া ২০১০ সালে ছাত্রলীগের দুই দলের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাবি শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিক। ফাহাদ আর আবু বকরের মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন রাষ্ট্র বির্নিমাণের হাতিয়ার হওয়া, থাকিয়ে থাকা পরিবারের হাল ধরা, ঘুণে ধরা সমাজের কালো হাত ভেঙে দেয়া, অপশক্তির উচ্ছেদ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, বস্ত্রহীন, অন্নহীন, আশ্রয়হীন মানুষের পাশে থাকা। কিন্তু ছাত্ররাজনীতির রোষানলে পড়ে ধূলিসাৎ হচ্ছে জীবন আর স্বপ্ন। এ কেমন ছাত্ররাজনীতি?
আবার শিক্ষকদের একটা বড় অংশ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন কোনো না কোনা ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততাই এর অন্যতম কারণ। শিক্ষক হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা তার জন্য সহজ। এমনকি সমসাময়িক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ফলে আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগরের পরিবর্তে সে হয়ে যায় দলের চাটুকার। নিজ দলের আদর্শ লালনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতের সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেও অন্যদের সঙ্গে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বজায় থাকে। ক্লাস টেস্ট পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট বা ভাইভাতে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন দল-মতের শিক্ষার্থী থাকায় একজন শিক্ষকের উচিত নিরপেক্ষ পাঠদান।
ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের তুলনায় কম মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রবণতা বেশি। সমসাময়িক ক্ষমতাসীন দলের হুকুমে মেধাবী আমলাদের নিয়ন্ত্রণ এর অন্যতম কারণ। আমার মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক দু’জন ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিল তোমরা বড় হয়ে কী হবে? মেধাবী শিক্ষার্থী বলেছিল সে বড় হয়ে সরকারি কর্মকর্তা হবে আর লাস্ট বেঞ্চের শিক্ষার্থী বলেছিল সে রাজনীতি করবে অর্থাৎ জনপ্রতিনিধি হবে। ছাত্রপ্রতিনিধি থেকে জনগণের প্রতিনিধি হওয়া ছাত্ররাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে। যখন দেশের নেতৃত্বে থাকবে লাস্ট বেঞ্চের শিক্ষার্থী আর যাই হোক দেশের ভাগ্য উন্নয়ন হবে না।
ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা বড় অংশ পড়াশোনা কমপ্লিট করার আগে ঝরে পড়ে। বড় ভাইদের দালালি, রাতভর মাদকদ্রব্য সেবন আর সারাদিন মিছিল-মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকা ব্যক্তির দ্বারা পড়াশোনা ঠিকঠাক হয় না। পড়াশোনার খরচ বহন করা পিতামাতার কাছ থেকে দূরে থাকায় সন্তানের দেখাশোনা ঠিকভাবে করতে পারে না। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষে পিতামাতা চাকরির জন্য চাপ দিতে থাকে। অনিয়মিত পড়াশোনা আর চাকরি না পাওয়ায় হতাশায় ভোগে। অনেকে জীবন থেকেও ঝরে যায়। বেছে নেয় আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ। এর প্রবণতা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে বেশি পরিলক্ষিত হয়। উচ্চ মধ্যবিত্ত বা অতি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে পিতামাতার টাকায় সন্তান উদ্যোক্তা বা ব্যবসার কাজে নিয়োজিত হয়ে অনায়াসে জীবনের গতিময়তা ফিরিয়ে আনতে পারে।
‘জোর যার মুল্লুক তার’ এই ধারায় ছাত্ররাজনীতি প্রভাবিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন ছাত্র পক্ষের সংঘর্ষে বা অযৌক্তিক কারণে ক্লাস পরীক্ষা স্থগিত থাকে। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়ায় চাকরিতে বৈচিত্র্য ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ও জীবনযাপনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে মেধাবী ছাত্রদের বড় অংশ বিদেশে পাড়ি দেয়। ইউনেস্কোর তথ্য মতে, প্রতি বছর ৭০ থেকে ৯০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত দেশে গমন করে। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বদেশে ফিরে আসে না। ওই দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তাই মেধা পাচার রোধে কলুষিত ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিকল্প নেই।
বিশ্বের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে দলান্ধ বা লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নেই। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কথা বলবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা প্রতিবাদ করবে, ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে, নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করে ভবিষ্যতে দেশের কাণ্ডারি হবে, শিক্ষার মাধ্যমে দীক্ষা নিয়ে বাস্তব জীবন পরিচালনা করবে, মূল্যবোধের অবক্ষয় হয় এমন সব অপসংস্কৃতি পরিহার করবে। কিন্তু বর্তমান ছাত্ররাজনীতি এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো মুক্ত চিন্তার পবিত্র স্থান যেখানে শিক্ষার্থীরা মুক্তভাবে কবিতা লিখবে, গান গাইবে, আবৃত্তি করবে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চার্চা করবে, দেশকে পরিচালনার জন্য নেতৃত্বের গুণাবলি শিখবে, সুশৃঙ্খল মতাদর্শ লালন করবে। নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে এবং পরবর্তী প্রজš§কে প্রস্ফুটিত করতে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিকল্প নেই।