ইমরান হুসাইন: নতুন বছরের শুরু থেকেই সার্স ভাইরাসের ওমিক্রন ধরন বেশ আতঙ্ক ছড়িয়েছে। কয়েকদিন ধরে কভিডের দৈনিক সংক্রমণও হঠাৎ বাড়তে শুরু করে। ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত শুক্রবার এ নির্দেশনাসহ ছয়টি জরুরি নির্দেশনা জারি করেছে। নির্দেশনায় আরও ছিল ২১ জানুযারি (শুক্রবার) থেকে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সব স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থাগ্রহণ করবে। রাষ্ট্রীয়?, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি উপস্থিত থাকতে পারবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট কিংবা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর সার্টিফিকেট আনতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, সামাজিক অনুষ্ঠানে যারা যোগ দেবেন তাদের ভ্যাকসিন গ্রহণের সনদ থাকতে হবে। রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে এই নিয়ম থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন এমন নিয়ম থাকবে না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তো সচেতন ব্যক্তিদের বিচরণ। প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বয়স কম। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর তারা কি ঘরে থাকবে? না থাকতে পারবে? তাই শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সীমিত পরিসরে ক্লাসের ব্যবস্থা করা হোক। সব শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যবিধি পরিপূর্ণভাবে মানার জন্য কঠোর ব্যবস্থা করা হোক। নিয়মকানুন মেনে সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা চালু থাকুক। ক্লাসে ভ্যাকসিন সনদ দেখিয়ে প্রবেশ করানো হোক। যেখানে সমাবেশে ১০০ লোক আসতে পারবে, সেখানে একটা ক্লাসে ৫০ জন নিয়ে ক্লাস করা সম্ভব।
৪ ও ৫ নম্বর নির্দেশনায় বলা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিল্পকারখানায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট গ্রহণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দায়িত্ব বহন করবে এবং বাজার, মসজিদ, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, রেলস্টেশনসহ সব ধরনের জনসমাবেশে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। মানে সব জায়গাগুলোই সচল আছে। সবকিছুই চলবে তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরিধান করে এবং ভ্যাকসিন গ্রহণের সনদ নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাফেরা করবে সবাই। কিন্তু প্রশ্ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কি এ নিয়ম-কানুনগুলো মানতে নারাজ ছিল যে হঠাৎ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলো? মনে হয় না কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মানতে অস্বীকার করেছিল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই কি শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা নিরাপদ? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে শুধু ওই প্রতিষ্ঠানই বন্ধ থাকবে। আগের ন্যায় স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করবে শিক্ষার্থী- শিক্ষকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আর সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চললে কী লাভ হবে জনসাধারণের? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই যে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ হয়ে গেল, এ নিশ্চয়তা কি আছে? সব শিক্ষার্থীই কোনো পরিবারের সদস্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে সে বাড়িতে থাকবে কিন্তু তার পরিবারের অন্য সদস্যরা আয়-রোজগারের জন্য ঠিকই বাইরে যাবেন। শিক্ষার্থী তা থেকেও অসুস্থ হতে পারে। তাই সে ঘরেও নিরাপদ নয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেক বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল থাকলে কোটি মানুষের আয়-রোজগারের পথ সচল থাকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা দু’মুঠো ভাত খেতে পারে তিনবেলা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেই স্বাভাবিকভাবে তাদের পরিশ্রমী হাত দুটো চলে যায় মাথায়। চিন্তা, হতাশা গ্রাস করে তাদের। এটি বেদনাদায়ক। একটু ঠান্ডা মাথায় বিষয়গুলো ভাবা উচিত।
মন্ত্রিপরিষদ অনেক বিজ্ঞ। অনেক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ করে সবকিছু যদি অনলাইনেই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তাহলে বাংলাদেশের পেক্ষাপটে এটা আরেকবার ভুল হবে। বর্তমান প্রজন্ম এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এর করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে। গত এক বছরে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম অর্থাৎ পাঠদান সম্ভব হলেও পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি। অনেকেই বলবেন যে, অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। কিন্তু ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নামে কী হয়েছে কমবেশি সবাই জানেন। এটাকে মূলত পরীক্ষা বললে ভুল হবে। গত এক বছরে অনলাইন ক্লাসের স্বাদ আমরা খুব ভালোমতো পেয়েছি। ডিভাইস না থাকা, নেটওয়ার্ক না থাকা, ডেটা না থাকা, পর্যাপ্ত পরিমাণ পরিবেশ না থাকাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার স্বীকার হতে হয়েছে আমাদের। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকে ক্লাসের উপস্থিতির ওপর নম্বর না থাকার ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে সেই কথা রাখেননি শিক্ষকরা। পছন্দের ছাত্র অনুযায়ী নিজের ইচ্ছামতো নম্বর বসিয়ে রেখেছেন। ফলে বেগ পেতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। অনেকে অনলাইনে ক্লাস করেও পরীক্ষা দিতে পারেনি অনলাইনে। ফলে দুই সেমিস্টারের পরীক্ষা একই সঙ্গে দিতে হয়েছে। অন্যদিকে কভিডকালে প্রথম ছুটিতে ১৫ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শুধু গত বছরেই ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই ৫০ জন! আরও অনেক হিসাবের বাইরে আছে, যাদের পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আসে না। এর পরেই আছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব বাল্যবিয়ে। শিক্ষার্থীদের সুস্থতার জন্য, তাদের নিরাপদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেন কিন্তু আসলেই কি আমরা নিরাপদে থাকতে পারছি?
দেশের অন্য সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। সবকিছু খোলা রেখে হঠাৎ করেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ন্যায্য সমাধান নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি কভিড সংক্রমণের কারখানা নয় যে, এটাকে বন্ধ করলে আর সার্স ভাইরাস উৎপাদন হবে না কিংবা এখান থেকেই করোনা ছড়াচ্ছেÑএটা বন্ধ করলে বাকি সব নিরাপদ হয়ে যাবে? তাই শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের দাবি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও সশরীরে ক্লাস পরীক্ষা চালু রাখুন। জনসচেতনতা গড়ে তুলুন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাই একমাত্র সমাধান হতে পারে না।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়