Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 3:13 pm

শিক্ষাব্যবস্থায় ভূমি, আইন ও কর্মসংস্থান সংক্রান্ত তথ্য যুক্ত করা আবশ্যক

আনোয়ারুল ইসলাম: দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ও প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা বলেন, শিক্ষা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র যা তুমি পৃথিবীকে পরিবর্তন করার জন্য ব্যবহার করতে পারো। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিবেকানন্দের বিখ্যাত উক্তি, ‘শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।’ বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন বিষয় সমসাময়িক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন, সংযোজন ও সংশোধিত হয়েছে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন, পরিকল্পনা ও সংস্কারের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই শিক্ষা কমিশনগুলো শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে কুদরাত-এ- খুদা কমিশন কয়েকটি প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা, প্রাথমিক শিক্ষা সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা এবং মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদান।

বাংলাদেশের পরবর্তী শিক্ষা কমিশন শিক্ষামন্ত্রী মাজিদ খানের নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কমিশন ১৯৮৮ সালে রিপোর্ট প্রদান করে। কমিশনটির গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল শিক্ষার বেসরকারিকরণের ওপর গুরুত্ব, মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়ন প্রভৃতি। পরবর্তী সময় গঠিত হয় ড. শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, যা ১৯৯৭ সালে গঠন করা হয়। ওই শিক্ষা কমিশনের অন্যতম প্রস্তাবগুলো ছিল যথাক্রমে শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থার উন্নয়ন, কারিগরি শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি।

২০০৯ সালে গঠিত হয় জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং ২০১০ সালে রিপোর্ট প্রদান করে। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনাগুলো ছিল প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাকে বিনামূল্য ও বাধ্যতামূলক করা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উন্নয়ন, শিক্ষায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ওঈঞ) ব্যবহার বাড়ানো প্রভৃতি। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা, মেয়েদের শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব, কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের জন্য কতটুকু কার্যকর বা দৈনন্দিন জীবনে কতটুকু প্রয়োগ করতে পারি, তা এখনও বিবেচ্য বিষয়। আমরা জানার জন্য পড়ি, নাকি বাস্তব জীবনে প্রয়োগের জন্য, তা এখনো প্রশ্নাতীত।

একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে এবং অতি দ্রুত উন্নতি ত্বরান্বিত করতে দেশের জনগণের দক্ষ মানবশক্তিতে পরিণত হতে হয়। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় দক্ষ মানবশক্তি না থাকায় এবং আইনের শাসনে যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দেশগুলোয় ব্যাপকহারে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সচরাচর ঘটে। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক ২০২৩ সালের জন্য দুর্নীতির ধারণাসূচক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতির মাত্রা বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো। তৎকালীন সময়ে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘যখন দুর্নীতি ও মানবাধিকার নিয়ে কথা বলি, তখন তারা (সরকার) ষড়যন্ত্রের কথা বলে। সরকারের লোকজন এমনভাবে কথা বলেন, সবাই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটা কথা বললে সেটাকে স্বীকৃতি দিয়ে দুর্নীতিকে কমানোর মানসিকতা নিয়ে তারা কাজ করেন না।’

দেশের দুর্নীতি কমানোর জন্য দেশের প্রত্যেকটি শিক্ষিত ও দক্ষ নাগরিকের আইন-কানুন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা জরুরি। আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায় শুধু যারা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে, তারাই আইনের নিয়মকানুন সম্পর্কে অবগত থাকে, যে কারণে শুধু আইন বিভাগ ছাড়া দেশের আইন-কানুন ও নিয়মাবলি সম্পর্কে অন্য নাগরিকরা অবগত থাকে না। অথচ দেশের আইনের ধারাগুলো পাঠ্যপুস্তকে ধারাবাহিকভাবে প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত যদি উল্লেখ থাকত, তাহলে এদেশের প্রতিটি শিক্ষিত মানুষ আইনের বিষয়ে অবগত থাকত। এ অবস্থায় তাদের চোখের সামনে যখন দুর্নীতি হতো বা আইন খেলাপি হতো তখন তারা সে বিষয়ে অবগত থেকে তা প্রতিবাদ করতে পারত। কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল দেশের দুর্নীতি ও নানা ধরনের অপকর্মকাণ্ড।

সংবিধান একটি দেশের মৌলিক আইন, যা রাষ্ট্রের কাঠামো, কার্যক্রম ও নাগরিকদের অধিকার নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২ সালে গৃহীত হয় এবং এটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতীক। সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করে, যেমন জীবন, স্বাধীনতা ও সমতার অধিকার। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়।
এছাড়া সংবিধান রাষ্ট্রের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে, যা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এটি রাষ্ট্রের নীতিমালা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে, যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা হয়, যাতে তারা জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে না পারে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত কতজন মানুষ সংবিধানের ধারাগুলো সম্পর্কে অবগত? সচরাচর দেখা যায়, যারা চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়, তারা সংবিধান মুখস্থ করে। শুধু চাকরির পরীক্ষার জন্যই তারা সংবিধানের ধারাগুলো পাঠ করে। এ অবস্থায় আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি রোধ করা, আইনের শাসন খেলাপি এবং রাষ্ট্রের সংবিধানবহির্ভূত কার্যাবলি সম্পন্ন হয় প্রায়ই। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো কী কী, রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয়, আইনের শাসন কী, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ কীভাবে পরিচালিত হয়, দেশের সংবিধানে কী কী বলা হয়েছে, ওই বিষয়গুলো দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরই অজানা।

পাঠ্যপুস্তকে প্রাথমিক স্তর থেকে যদি সংবিধানের ধারাগুলো পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করা যেত তাহলে দেশের মানুষ সংবিধান সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারত। এক্ষেত্রে দেশের সংবিধানে কোন কাজগুলো বৈধ এবং কোনগুলো অবৈধ সে সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অবগত থাকত। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংস্কার আনা প্রয়োজন। তা হলো জমিজমার হিসাব ও সংশ্লিষ্ট আইন। বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জমি-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা জমিজমা বিরোধের কারণে দায়ের করা হয়েছে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে জমি-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে মারামারি ও হানাহানির খবর পত্রিকার পাতায় সবসময়ই দেখা যায়। অবৈধভাবে জমি দখল, জমির মালিকানা-সংক্রান্ত ঝামেলাসহ নানা জমি-সংক্রান্ত অপরাধমূলক কর্মাণ্ড ঘটছে প্রতিনিয়ত। ভূমি অফিসে লাল ফিতার বাধা, আমিনের স্বচ্ছতাসহ জমি-সংক্রান্ত নানা কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অনিয়ম আখড়া গেড়ে বসেছে।

জমি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে যদি শেখানো যায়, তাহলে দেশে জমিজমার বিরোধগুলো কমে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। সাধারণ মানুষের জমি-সংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দেশের পাঠ্যপুস্তকে জমি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করা জরুরি। নকশা, দলিল, খতিয়ান, জরিপ প্রভৃতি বিষয় স্তরে স্তরে উল্লেখ রাখা জরুরি। বর্তমান বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি’ নামক বিষয়, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার সম্পর্কে তাত্ত্বিক ধারণা দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে শিক্ষার্থীরা তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়গুলো হাতে-কলমে শিখতে পারছে না। অধিকাংশ শিক্ষকের সীমাবদ্ধতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় পর্যাপ্ত প্রযুক্তিসম্পন্ন যন্ত্রের অভাবে তথ্যপ্রযুক্তির সম্মক জ্ঞান পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীরা জানে না কীভাবে ভালো সিভি লিখতে হয়, ই-মেইলের নিয়ম প্রভৃতি। কম্পিউটার শেখা প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মতো উচ্চ ধারণাগুলোও দেয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি, দেশের গতবাঁধা মুখস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার গণ্ডি থেকে বের হয়ে কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত। শুধু বিসিএসনির্ভর পড়াশোনা বা সরকারি চাকরির দিকে লক্ষ না রেখে শিক্ষার্থীরা যেন প্রযুক্তিগত এবং অন্যান্য বিষয় তৃণমূল পর্যায় থেকে শিখে আসতে পারে, তার ওপর জোর প্রদান করা উচিত। যার মাধ্যমে দেশে বেকারের সংখ্যা কমিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের উন্নতিসাধন সম্ভব।