চলতি বছর শিক্ষক দিবসে প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘শিক্ষা, নৈতিকতা ও সমাজগঠনে শিক্ষকের ভূমিকা।’ শিক্ষা ব্যবস্থা তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। স্তম্ভ তিনটি হলো শিক্ষাঙ্গন, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। এই তিনটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হচ্ছে শিক্ষক। শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। কাজেই শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক মানোন্নয়নে আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে শিক্ষক সমাজ। শিক্ষকতা অন্যের সন্তান পুত্রস্নেহে মানুষ করার এক মহান ব্রত। শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়। পেশাদারিত্ব নির্দিষ্ট বৃত্তে সীমায়িত। শিক্ষক দিবসে শিক্ষক-শিক্ষার্থী দাতা-গ্রহীতার ভূমিকা অনুধাবন করার সুযোগ পায়। উঁচু ক্লাসের শিক্ষার্থীরা নিজ বিদ্যালয়ে নিচু ক্লাসে শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পাঠদান করে। এভাবেই একটি শিক্ষাদান বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এই দিনে শিক্ষার্থীদের মনে জন্ম নেয় প্রতিজ্ঞা ও সংকল্প। মননে জাগ্রত হয় শিক্ষকপ্রীতি ও শিক্ষক হওয়ার বাসনা। শিক্ষক দিবস শিক্ষকদের গুরুত্ব প্রদানের দিন। প্রতিবছর শিক্ষক দিবসে শিক্ষকতা পেশার যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান নিয়ে কথা বলা হয়। শিক্ষকদের সম্মান বৃদ্ধির জন্য করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। শিক্ষকদের মানোন্নয়নে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়। সাবেক ও বর্তমান শিক্ষকদের অবদানের কথাও দিবসটি পালনের মাধ্যমে প্রতিবছর স্মরণ করা হয়। শিক্ষক দিবস আমাদের কাছে একটি মহান দিবস হিসেবেই বিবেচিত। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘দৌজ হু আর ডেভোটেড টু টিচিং চিলড্রেনস আর মোর অনারেবল দ্যান দৌজ হু আর আনএজুকেটেড।
প্যারেন্টস গিভ আস লাইফ রাইট। টিচার্স হেল্প বিল্ড দ্যাট লাইফ বিউটিফুললি।’ শিক্ষা খাত সময়ের সেরা বিনিয়োগের ক্ষেত্র। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। ভারতের নোবেলবিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী বলছেন, শিক্ষায় এক ডলার বিনিয়োগ করলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে ১৫ গুণ রিটার্ন পাওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ বাড়াতে হবে। আগ্রহী শিক্ষার্থীদের স্বচ্ছ ও যুগোপযোগী মূল্যায়নের মাধ্যমে এই পেশায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
শিক্ষা গবেষকদের গবেষণালব্ধ তথ্যমতে, মানসম্পন্ন শিক্ষার ৮৫ শতাংশ নির্ভর করে শিক্ষকের ওপর। শিক্ষক যদি অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করে সেখানে শিক্ষা বিস্তার কীভাবে সম্ভব? শিক্ষকের মানসম্মত শিক্ষা প্রসারের জন্য অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া শিক্ষকদের থেকে মানসম্মত শিক্ষা আশা করা বোকামি। অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব, পেশাগত বৈষম্য এবং কতিপয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের অসদাচরণ শিক্ষকতা পেশাকে বিরক্তিকর করে ফেলেছে। গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর সহস্রাধিক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দেন। এটি অন্য কোনো পেশায় হয় কি না সন্দেহ। বিশ্বের অন্যান্য দেশে শিক্ষকতা পেশাকে যেভাবে প্রাধান্য দেয়া হয়, বাংলাদেশে এই পেশাকে সেভাবে প্রাধান্য দেয়া হয় না। ফলে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও শিক্ষকতা পেশা হিসেবে আকর্ষণীয় নয়। বাংলাদেশের শিক্ষকদের মধ্যে এখনও রয়েছে নানা অসন্তুষ্টি। মাধ্যমিক শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের সম্মানীতে বৈষম্য রয়েছে। দেশের বেসরকারি শিক্ষকসমাজ আর্থিক দিক বিবেচনায় খুবই হতাশ।
২৬ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। হতাশাগ্রস্ত শিক্ষক সমাজ নানা কারণে শিক্ষা দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাই মেধাবী শিক্ষিত সমাজ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে আগ্রহ দেখালেও শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করেন।
একজন শিক্ষক ভবিষ্যতে সুযোগ সৃষ্টি ও যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করেন। এজন্য শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। শিক্ষকদের জন্য যুগোপযোগী ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের আত্মোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। একজন আদর্শ মানুষ গড়তে আদর্শ শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিশ্বের সব শিক্ষককে জন্য রইল আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।