শেগুফতা শারমিন: বিনু সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে মাকে বলল, মা ভাত দাও। সকাল শিফটে স্কুল হওয়ায় বিনুর মা রহিমা বেগম সকালেই মেয়ের জন্য ভাত রান্না করে দেন। রহিমা বেগম ভাত খেতে দিয়ে বিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বিনু দ্রæত ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যায়। একদিনও বিনু স্কুল বাদ দেয় না। বিনুর মা ভাবতে থাকেন, পড়ালেখা তার কপালে জোটেনি। স্কুলে যাওয়া তার ভাগ্যে ছিল না। খুব অল্প বয়সেই সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করতে হতো। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাশের গ্রামের দুলাল মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে রহিমা বেগমের ওপর। বিয়ের দুই বছর পরই বিনুর জš§ হয়।
বিনু যখন বলে ‘মা স্কুলে যাচ্ছি’ তখন মায়ের বুক জুড়িয়ে যায়। ল²ীপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে মা-বাবা, বিনু আর তার ছোট বোন শিউলীসহ চারজনের বসবাস। বিনুর বাবা দুলাল মিয়া একজন কৃষক। চাষাবাদের অল্প কিছু জমি আছে। স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ চারজনের সংসার কোনোভাবে চলে যায়। কিন্তু মেয়েকে লেখাপড়া করানো দুলাল মিয়ার খুব ইচ্ছা।
বিনু এবার গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। ক্লাসে প্রথম হয় বিনু। লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভালো সে। তাই স্কুলের শিক্ষকরা সবাই বিনুকে অত্যন্ত আদর ও স্নেহ করেন। পড়া না বুঝলে শিক্ষকরাই তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেন। বিনুর মা-বাবার স্বপ্ন, মেয়ে একদিন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে এবং অনেক বড় চাকুরে হবে। বাড়ির পাশে স্কুল বিধায় বিনুকে স্কুলে যাওয়া-আসা নিয়ে মা-বাবাকে কোনো চিন্তা করতে হয় না। বড় মেয়ে বিনুর লেখাপড়ার সাফল্যে মা-বাবা খুব খুশি। তাই দুলাল মিয়ার ছোট মেয়ে শিউলীও একই বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপের কারণে এখন গ্রামাঞ্চলের দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। সকাল হলেই দেখা যায় গ্রামের মেয়েরা দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ছোট কমলমতি শিশুদের কলরবে মেতে উঠেছে। বছরের প্রথম দিন স্কুল থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হচ্ছে। মেয়েরা উপবৃত্তির টাকা পাচ্ছে। সেই টাকায় তারা লেখাপড়া করছে, নিজেদের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটাচ্ছে। লেখাপড়ার আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে উপবৃত্তির এ টাকা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তা করছে।
সরকারের উপবৃত্তি কার্যক্রম মেয়েদের শিক্ষা লাভে আগ্রহী করে তুলেছে। দরিদ্র ঘরের মেয়েরা এখন অন্যের বাড়িতে কাজ না করে স্কুলে যাচ্ছে। এর সঙ্গে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে স্কুলে মিড-ডে মিল কার্মসূচি। স্কুলগুলোতে সরকার দুপুরে উন্নতমানের খাদ্য বিতরণের ফলে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার হার যেমন বেড়েছে, তেমনি শিশুর পুষ্টি চাহিদাও অনেকাংশে লাঘব হচ্ছে।
অনেক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে। তাদের এই সাফল্য দেখে অন্যরাও স্কুলগামী হচ্ছে। নারী শিক্ষার ব্যাপকতা অনেক বেড়েছে। সরকারের পাশাপাশি অনেক বেসরকারি সংস্থা গ্রামপর্যায়ে স্কুল স্থাপন করে নিরক্ষরতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ আবদান রাখছে। এতে নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়ন দুটোই বাড়ছে।
সরকার নারী শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও উৎসাহিত করার জন্য উপবৃত্তি চালু করেছে। নারী শিক্ষা আরও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকার মেয়েদের জন্য দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া অবৈতনিক করেছে। এতে গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের মধ্যে শিক্ষা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তারা এখন মেয়েদের শুধু ঘর গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত না রেখে স্কুলে পাঠাচ্ছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের ফলে প্রাইমারি স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার অনেক কমে এসেছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে দেশের শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হার শতভাগসহ নারী শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। গত ১০ বছরে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ৬২ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৪ শতাংশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার ১০ শতাংশ বেড়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রেখেছে উপবৃত্তি। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ এবং উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে নি¤œ আয়ের পরিবারে মেয়েদের ভর্তির হার বৃদ্ধিতে বিরাট ভ‚মিকা রাখছে।
মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা গ্রহণে বাংলাদেশের নারীরা এখন বিশ্বের অন্য দেশের জন্য উদাহরণ। মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষা গ্রহণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সবার ওপরে। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৪৯ শতাংশ, সেখানে বাংলদেশে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫২ শতাংশই ছাত্রী। গত ১০ বছরে শিক্ষার্থীদের মাঝে ২৯৬ কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করেছে সরকার, যার নজির বিশ্বের কোনো দেশে নেই।
বর্তমান সরকারের সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসঙ্গটি অন্যতম। প্রাথমিক শিক্ষা যুযোপযোগী না হলে শিক্ষাব্যবস্থা টেকসই হয় না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গত ১০ বছরে ২৫ হাজার ২৪০টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় গত ১০ বছরে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। ২০০৫ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৭ দশমিক দুই শতাংশ, বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ১০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। গত ১০ বছরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, শিশুদের মধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতির শিক্ষা কার্যক্রম বিস্তার ঘটানোর লক্ষ্যে বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আরও একটি যুগান্তকারী সাফল্য হলো দেশের শিক্ষার্থীর মাঝে দুপুরের খাবার বিতরণ এবং বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় নতুন নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন। এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ের এক কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসে উপবৃত্তি গ্রহণ করছে, যা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
সরকারের সহযোগিতায় বিনুর মতো দরিদ্র শিক্ষার্থীরা এগিয়ে চলেছে। মা-বাবা হিসেবে সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার চেয়ে বড় সার্থকতা আর কিছু নেই। দরিদ্র ঘরের মেয়েদের এখন আর লেখাপড়ার জন্য ভাবতে হয় না। সরকার তাদের সঙ্গে আছে।
বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং উপবৃত্তি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য এক বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশে। অর্থের অভাবে বই ক্রয় করতে না পারা শিশুরাও এখন নিশ্চিন্তে বিদ্যালয়ে চলে আসতে পারছে। এটা সরকারের এক যুগান্তকারী সাফল্য। সরকার সোনার বাংলায় সোনার কন্যাশিশুকে গড়ার দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।