প্রতিনিধি, জবি: ২০২১ সালে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো সমন্বয় করে দেখা গেছে, গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১০১টি। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, যা ৬১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বা ৬২ জন।
মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১২তে, যা মোট আত্মহননকারীর ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যাটি চার, যা মোট আত্মহত্যাকারীর তিন দশমিক ৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা সংখ্যায় ২৩ জন।
গতকাল আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েছে আত্মহত্যা: হতাশায় নিমজ্জিত শিক্ষার্থীরা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য উঠে এসেছে। বিভিন্ন সময় জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহননকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে রাজধানীর দুই বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (৯) ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (৬) শিক্ষার্থীরা। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন আত্মহত্যা করেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যাদের সংখ্যা তিনজন।
আত্মহননকারীদের বয়সভিত্তিক তথ্য পর্যালোচনায় উক্ত সংগঠনের সমীক্ষার ভিত্তিতে দেখা গিয়েছে ২২ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি, যা মোট আত্মহত্যার ঘটনার ৫৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। অনার্স পড়ুয়া তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার তুলনামূলক বেশি, যা ৩৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ধারণা করা হয়, এই শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ারকেন্দ্রিক সামাজিক চাপ বেশি থাকে ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার কারণে তাদের মাঝে হতাশার ছাপ বেশি দেখা যায়।
সাধারণত নারী শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার হার বেশি দেখা গেলেও আঁচল ফাউন্ডেশনের এবারের তথ্য থেকে দেখা যায়, গত বছর আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশই ছিল পুরুষ শিক্ষার্থী। সর্বমোট ৬৫ জন পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, যা মোট শিক্ষার্থীর ৬৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ছিল ৩৬ জন বা ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। বিশেষভাবে লক্ষণীয়, পুরুষ আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যা নারীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। কভিডের মধ্যে সামাজিক, আর্থিক ও পারিবারিক চাপ বেড়ে যাওয়া পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধানে উঠে আসে সম্পর্কগত কারণ। এ কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে এ পথে ধাবিত হয়েছে ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অন্যদিকে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। এছাড়া পড়াশোনা-সংক্রান্ত কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং আর্থিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন চার দশমিক ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। সমন্বয়কৃত তথ্য থেকে আরও দেখা যায়, মাদকাসক্ত হয়ে নির্বিকারে নিজের জীবন হননের পথ বেছে নিয়েছে এক দশমিক ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। এছাড়া আরও নানা কারণে আত্মহত্যা করেছেন মোট ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারাকে আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আত্মহত্যার কারণগুলো বাইরে থেকে যতটা দেখা যাচ্ছে, সমস্যা তার চেয়েও গভীর। নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয় শিক্ষার সুযোগ অপর্যাপ্ত বিধায়, তাদের জীবনে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে তারা সেটা সামলাতে পারে না। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এখনই পদক্ষেপ নিতে না পারলে পরবর্তীতে আমাদের অনুশোচনা করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা বৃদ্ধির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বিশেষত কভিড পরিস্থিতিতে এই বিষয়ের পরিসংখ্যান এবং তার ফলাফল যথেষ্ট ভীতিকর। কভিড নিয়ে আমরা যতখানি আতঙ্কিত, আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করা অসংখ্য মানুষকে নিয়ে কিন্তু আমরা ততটা চিন্তিত নই। আমি বিশ্বাস করি, যদি সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা যায় এবং প্রতিটি জেলায় আত্মহত্যা সেল গঠন করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়, তবে অনেকাংশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।’
আত্মহননের সংখ্যায় জবির শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থানের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান এবং জবি শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বলেন, আত্মহত্যার যে প্রবণতা তা একদম শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে এমন মানসিক অবস্থাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও এখানকার শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার বিষয়ে এখন সচেতন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩ জানুয়ারি থেকে কভিডে বন্ধের আগ পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থী কাউন্সিলিং সেন্টারে রেজিস্ট্রেশন করেছেন এবং তার অর্ধেক-সংখ্যক শিক্ষার্থী কাউন্সিলিং নিয়েছেন। এ সংখ্যাটি বেশ সন্তোষজনক।