শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে হবে

জাফর হোসেন জাকির: সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২১ জানুয়ারি থেকে দুই সপ্তাহের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। সেই ছুটি শেষ না হতেই আবারও দুই সপ্তাহ অর্থাৎ ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি বাড়িয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা এক গভীর সংকটে পতিত হবে। সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে ৮ মার্চ ২০২০ সাল থেকে ১৮ মাস দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সরকার পক্ষ বলছিল, আমরা অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছি। ফলে শিক্ষার্থীরা তেমন ক্ষতির মুখে পড়েনি। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম চালু আছে এবং ভবিষ্যতে সশরীরের পাশাপাশি অনলাইনকে প্রসারিত করতে চায়। কভিডকালে দেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ গ্রামীণ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে ছিল বলে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে। এর কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকগুলো হেতু পাওয়া যায়। যেমন : বেশির ভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থীর পরিবার হতদরিদ্র, দিন এনে দিন খাওয়া, যাকে বলে হাত চললে পেট চলে, নিন্ম আয়ের, নিন্ম-মধ্যবিত্ত ও কৃষিনির্ভর। যেই শিক্ষার্থীর পরিবার হতদরিদ্র তার বাবা-মা সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। স্মার্ট ফোন কেনা তাদের জন্য আকাশ ছুঁয়ে দেখার মতো। যার পরিবার দিন এনে দিন খায় সেই পরিবারে স্মার্ট ফোন থাকা কল্পনার বাইরে। আর স্মার্ট ফোন না থাকলে অনলাইনের ক্লাসের দুয়ার বন্ধ, যেমনি করে সশরীরে ক্লাসের দরজা বন্ধ। আবার যার পরিবার নিন্ম-মধ্যবিত্ত, কৃষিনির্ভর তাদের একটা কোনোরকমের ত্রিজি ফোন আছে এই ফাইভজি প্রবেশের যুগে। কিন্তু তাদের বাবা-মা গভীর রাত জেগে চিন্তা করতে থাকে দিনে দিনে যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে তাতে সংসার চলবে কেমন করে! ঋণ পরিশোধ করবে কেমন করে! ফসলের জমিতে ফসল লাগাবে কেমন করে! তার ওপর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে সন্তানের অনলাইন খরচ! এ যেন এক মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! বিশ্লেষণ করলে আরও অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন : বেশির ভাগ পরিবারের ডিভাইস কেনার সামর্থ্য না থাকা, গ্রামে ইন্টারনেটের গতি খুবই দুর্বল, প্রত্যেকের বাড়িতে টিভি নেই প্রভৃতি।

গ্রামে প্রায় প্রতিটি পরিবারে এনজিওর কিস্তি নামক অভিশাপ ঢুকে আছে। এনজিওগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কেউ জমিতে ফসল ফলায়, কেউবা অটোরিকশা, অটোভ্যান কিনে জীবিকা চালায়, কেউবা ঋণ নিয়ে দেনা পরিশোধ করে, কেউবা বন্ধকী জমি ছাড়ায়। সকালে ঘুম ভাঙার আগেই বাবা-মাকে চিন্তায় পড়তে হয়, আজকে কিস্তির টাকা কোথা থেকে আসবে। কিস্তি অথবা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেক কৃষক-শ্রমিক খেটেখাওয়া মানুষ গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে।

আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হয় প্রাইমারি স্কুল থেকে। প্রাইমারিতে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তার ৫ থেকে ৬ ভাগ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় টিকে থাকে। বাকি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। কারণ কী? কারণ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন বাণিজ্যিকীকরণে পরিণত হয়েছে। টাকা যার, শিক্ষা তার এই নীতিতে চলছে শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে প্রাইমারিতে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয় পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে খুবই অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট নিতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্যমতে, ২০১০ সালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪ জন। ২০২১ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় বসে ২২ লাখ ২৭ হাজার ১১৩ জন। প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক পার হতে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৯ হাজার ৯৮১ জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এইচএসসি পাস করে অনার্সে ভর্তি হয়ে কোর্স শেষ করে সার্টিফিকেট পাবে কতজন শিক্ষার্থী সেটা শুধু দেখার অপেক্ষা। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পিরামিডের অনুরূপ।

সার্স ভাইরাসের কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বদলে সরকার আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দীর্ঘ করছে। অথচ দেশের সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলছে। বাণিজ্যমেলা থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, গার্মেন্টস, শপিংমল, শিল্পকারখানা প্রভৃতি সবকিছু উম্মুক্তভাবে চলছে। বইমেলার ঘোষণাও এসেছে। তবে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে এত প্রহসন কেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে কি শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা বাইরে বের হচ্ছেন না? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বলে কি তারা বইমেলার মতো প্রাণের মেলায় যাবেন না? শিক্ষক-শিক্ষার্থী সব জায়গায় অবাধে চরাফেরা করছেন। তবে কি সার্স ভাইরাস শুধুই চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চে ও শিক্ষার্থীদের ব্যাগে ঢুকে আছে? সবকিছু চালু রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত অবিবেচনাপ্রসূত ও অযৌক্তিক। সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে বাণিজ্যমেলা, ব্যাংক, অফিস-আদালত, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র, শপিংমল প্রভৃতি জনসমাগম জায়গা বন্ধ ঘোষণা না করে সরকারের কাছে কভিড মোকাবিলার একমাত্র সমাধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া বিষয়টি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসনের নামান্তর।

শিক্ষার মধ্য দিয়ে জাতি উন্নত হয়; শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়; শিক্ষার মধ্য দিয়ে মানুষ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সঠিক-ভুল বুঝতে পারে, শিক্ষার মধ্য দিয়েই দেশে নেতৃত্ব দেয়ার নতুন মানুষ গঠন হয়। আর শেখানো কিংবা শেখার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আজ সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলছে। ফলে অনার্সে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা একই বর্ষে তিন বছর ধরে বসে আছে। ফলে দিনে দিনে বাড়ছে হতাশা। হতাশা আর নিঃসঙ্গ থেকে শিক্ষার্থীরা বেঁচে নিচ্ছে আত্মহত্যা। এক রিপোর্টে উঠে এসেছে ২০২১ সালে বিগত বছরের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাসে পাশের সিটে বসা নারী সহযাত্রীর সঙ্গে কথা হয়। তার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মাত্র কয়েকটা ক্লাস তার মেয়ে পেয়েছে বলে আক্ষেপ করে বলেন, শ্রেণিকক্ষে ক্লাস না করে পরীক্ষায় বসে রেজাল্ট আর কেমন হবে! উচ্চশিক্ষার জন্য এ অপূরণীয় ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠবে!

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা কিছুটা পুষিয়ে নিতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিকল্প নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচাতে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা সময়ের দাবি। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে। দুই বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমরা যখন সব খোলা রাখতে পারছি, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত।

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ

নীলফামারী সরকারি কলেজ

নীলফামারী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০