Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 5:24 pm

শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা

অর্পিতা ঘোষ: ইংরেজি ঊঃযরপং শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে নৈতিকতা। নৈতিকতা হচ্ছে চেতনাগত বিষয় এবং দ্বিতীয়ত তা আচরণের বহিঃপ্রকাশ। মূলত সামাজিক রীতিনীতি, ন্যায়-অন্যায়বোধ আর অর্জন-বর্জনের নির্দেশনায় নৈতিকতার স্বরূপ নিহিত। জš§ থেকে শিশু মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নিয়ে জš§গ্রহণ করে না। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজের মাধ্যমে শিশু মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিখে থাকে। শিশুর প্রথম নৈতিক শিক্ষা শুরু হয় পরিবার থেকে, পরবর্তীতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নৈতিকতার গুণাবলি শিখে থাকে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। তাই সমাজ সৃষ্টির শুরু থেকেই নৈতিকতাকে বিভিন্ন মনীষী বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নৈতিকতা সম্পর্কে উস্তাদ সাইয়্যেদ কুতুব (র.) বলেন, সমাজে যদি ন্যায় পরায়ণতা এবং নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে, তবে সে সমাজ সুশীল। দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হচ্ছে শিক্ষা। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মতোই একটি ইতিবাচক প্রেরণা যা মানুষের বিবেচনাবোধ ও মনুষ্যত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। মূল্যবোধ নিয়ে উইলিয়াম ইঞ্চ বলেছেন, শিক্ষা হলো জ্ঞান নয়, সত্য নয়, মূল্যবোধ।

নৈতিক শিক্ষা আর মূল্যবোধ অবিচ্ছেদ্য এবং একটি অপরটির পরিপূরক। মূল্যবোধ লালনের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি যেমন নিজেকে সমাজ সুন্দর জীবনপ্রকাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ঠিক তেমনি মূল্যবোধের পতন ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়। মূল্যবোধের মাধ্যমে ব্যক্তি নৈতিক বিচার এবং সঠিকতা যাচাই করতে পারে। একজন বিবেকবান মানুষ নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী হতে পারেন। কারণ বিবেকের সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সম্পর্ক নিবিড়; যা কিছু ভালো এবং মানুষ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর তার নিশ্চয়তা নৈতিকতার মাঝে নিহিত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হচ্ছে সর্বজন স্বীকৃত যেসব ভালো, সুন্দর, চমৎকার, শালীন, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও কল্যাণকর বিষয়; যা কোনো সমাজকে কল্যাণময় সোনালি সমাজে পরিণত করে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা এবং মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অতীব জরুরি একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের পরিচর্যায় একজন মানুষ সম্মান ও মর্যাদার আসন পায়। শিক্ষা মানেই শুধু জ্ঞানার্জন করে সার্টিফিকেট অর্জন করা নয়। মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে গিয়ে সুনাম অর্জন করা যায়, কর্মজীবনেও উচ্চ বেতনে উচ্চপদে সমাচীন হওয়া যায় কিন্তু নৈতিকতা ও মূল্যবোধ না থাকলে একসময় সবকিছুই ম্লান হয়ে যায়। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের নৈতিক শিক্ষায় ও শিক্ষিত করে তুলতে হবে একইসঙ্গে বিবেকবোধ জাগ্রত করে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। কেননা আজকের তরুণরাই জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।

যদি তারা নৈতিকতার শিক্ষায় শিক্ষিত না হয় তাহলে সমাজ, জাতি কোনো নিরাপদ এবং সঠিক পথের দিশা পাবে না বরং প্রতারিত হবে। তাদের প্রাপ্ত শিক্ষার ও বেড়ে ওঠার ওপর সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের, জাতির ভবিষ্যৎ কেমন হবে তা নির্ভর করে। তাই তরুণ প্রজš§ এবং তার ভবিষ্যৎ ও নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান প্রজš§কেই ভাবতে হয়। যে সমাজে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ দুর্বল সে সমাজ দুর্বল ও অনিরাপদ। আর এই শিক্ষা ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা জাতি উৎকর্ষ সাধন করতে পারে না। কারণ নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ পশুর সমান।
একজন শিক্ষা অর্জনকারী ব্যক্তি আলোকিত প্রদীপের মতো এবং একজন বিদ্যা বর্জনকারী ব্যক্তি আঁধারের সমতুল্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে নৈতিকতার মারাত্মক অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দিন দিন এই প্রবণতা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে; যা নিঃসন্দেহে একটি উদ্বেগজনক বিষয়। নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে চরিত্রের ক্ষয়প্রাপ্তি। নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিলুপ্ত ঘটা বা ধ্বংস নামা। দেখা যায় যত না অপকর্ম করছে মূর্খরা তার চেয়ে ও বেশি অপকর্ম করছে শিক্ষিত অনৈতিক মানুষগুলো।

দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রাহাজানি, প্রতারণা, সুদ, অনাচার, অবিচার, অ্যাকাউন্ট হ্যাক, শোষণ, নিপীড়ন, স্বার্থপরতা, ঘুষ, ধর্ষণ, হত্যা, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন, মাদকাসক্ত, ব্যভিচারের মতো কাজগুলো বেড়েই চলেছে। এমন কি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র কর্তৃক শিক্ষিকার, শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী শ্লীলতাহানির মতো নিকৃষ্ট ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এই নির্মম বর্বরতা থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরাও নিরাপদ নেই। নৈতিক শিক্ষার অধঃপতনের কারণে কিশোর অপরাধ বেড়েই চলেছে। শিক্ষার্থী কর্তৃক শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও কম নয়। মানুষ মানুষকে সামান্যতম স্বার্থের জন্য খুন করছে। এই অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব ও সর্বগ্রাসী অশ্লীলতার মতো আরও কিছু বিষয়। পেশিশক্তির প্রভাব, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সর্বোপরি লাগামহীন অশ্লীলতাই আজকের তরুণ সমাজকে চরম অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফলে আমাদের সুস্থ সমাজ, জীবনযাপন ও জীবন বিকাশের জন্য ক্রমেই প্রতিকূল হয়ে উঠেছে।

নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য একজন সন্তানকে প্রথম থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা প্রদান করা পরিবারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য। প্রকৃত মানুষ হতে হলে নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ গঠনের জন্য আমাদের প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। শুধু সঠিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চাই পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। এ সমাজকে পরবর্তী প্রজšে§র জন্য বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে সমাজে সর্বস্তরে সুশিক্ষার বীজরোপণ করতে হবে। পরিবার ও সমাজের যুবকদের চরিত্র গঠনের জন্য মা-বাবা, কর্তাব্যক্তিদের এগিয়ে আসা দরকার। যেহেতু নৈতিক শিক্ষাপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আদলের শিক্ষা নয়, তাই আমাদের সমাজকে ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য সুস্থ-সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নৈতিক মূল্যবোধের পরিচর্যায় সবাইকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। ঘুণে খাওয়া সমাজে মানুষের অনিরাপদ ও কষ্টকর জীবনকে কল্যাণধারায় অভিষিক্ত করতে হলে অবশ্যই নৈতিক মূল্যবোধের শক্তি বাড়াতে সচেষ্ট হতে হবে এবং সর্বস্তরের নাগরিককে ভবিষ্যৎ একটি সুস্থ সুন্দর ও নিরাপদ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সমবেতভাবে এগিয়ে আসতে হবে।