সামিয়া খানম : কোনো মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যম থেকে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের বা ধারণা লাভের এই যে প্রক্রিয়া, সেটিকেই মূলত শিক্ষা বলা হয়ে থাকে। এছাড়া আমরা আরও বলতে পারি, একজন ব্যক্তির আচরণের কাক্সিক্ষত বা ইতিবাচক পরিবর্তনই হলো শিক্ষা। এ হিসেবে পৃথিবীর কোনো মানুষকেই মূর্খ বলা যায় না, কারণ আমরা সবাই সবসময় কোনো না কোনো মাধ্যম থেকে শিক্ষা অর্জনের পথেই থাকি। কিন্তু শিক্ষা ও সাক্ষরতার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। কোনো মানুষ যখন অক্ষরজ্ঞান লাভ করে, তখনই তাকে সাক্ষর বলা হয়ে থাকে। তাই পৃথিবীর সব মানুষই শিক্ষিত হলেও সাক্ষর নয়। এই যে সাক্ষরতা বা অক্ষরজ্ঞান লাভের যে প্রক্রিয়া, সেটি বাংলাদেশে চারটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে; এগুলো হলো ১. প্রাক-প্রাথমিক, ২. প্রাথমিক ৩. মাধ্যমিক এবং ৪. উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়। এই চারটি পর্যায়ে মূলত ধাপে ধাপে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়। এই শিক্ষা প্রদানের বিষয়ের সঙ্গেও আবার বিভিন্ন বিষয় জড়িত রয়েছে, যেমনÑযথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষিত শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি। এই প্রত্যেকটি বিষয়ই একজন শিশুর যথাযথ স্বাক্ষর হওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। একজন যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষিত শিক্ষিত মানুষই পারে একটি শিশুর মেধার যথাযথ বিকাশে সহায়তা করতে, আর সেইসঙ্গে দরকার একটি উপযুক্ত সুন্দর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি সংকীর্ণ কোনো স্থানে স্থাপন করা হয়, তাহলে সেটি শিক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিকূল নাও হতে পারে। সময়োপযোগী শিক্ষায় শিক্ষা উপকরণও অত্যন্ত জরুরি। পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ থাকলে একজন শিক্ষার্থী সহজেই সব বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। এর সবকিছুর পরেও একঘেয়ে শিক্ষা শিক্ষার্থীদের খুব বেশি অপছন্দ, তাই শিক্ষার মাঝে বিনোদনের বিষয়টিকেও অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। সর্বোপরি বলা যায়, শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের মনের মতো করে, অর্থাৎ শিক্ষার্থীবান্ধব করে ঢেলে সাজাতে হবে। কিন্তু আদৌ কি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলোর পর্যাপ্ততা আমরা দেখতে পাই?
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়নের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হতে চলছে, কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় আসছে না তুলনামূলক পরিবর্তন। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ করি, তাহলে খুব স্পষ্টই দেখতে পাব, তারা শিক্ষার প্রত্যেকটি স্তরকে কত সুন্দরভাবে সাজিয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থার দেশ হলো ফিনল্যান্ড। সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে জনপ্রিয়তার কারণ হলো সেখানকার সর্বস্তরের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সমান গুরুত্বারোপসহ প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি জোর প্রদান করে শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটানো হয়। এছাড়া গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাদানের তালিকার প্রথম দিকেই রয়েছে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও জাপান। এই দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় এগিয়ে থাকার অন্যতম কারণ হলো তারা যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করে থাকে, অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী যে বিষয়ে অধিক দক্ষ, তাকে সেই বিষয়ে শিক্ষাদানে উৎসাহিত করা হয়। এছাড়া এ দেশগুলোয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান, যা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যেতে উৎসাহিত করে। সুতরাং বাংলাদেশে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা কীভাবে সম্ভবÑএ প্রশ্নের উত্তর হতে পারে, আমাদের শুধু একটি শিক্ষা বাজেট বা শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলেই চলবে না, এই বিষয়গুলোর সঠিক ও যথাযথ প্রয়োগ আমাদের নিশ্চিত করা ছাড়াও শিক্ষার সার্বিক দিকের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষালগ্নের সূচনাকে যদি ভালো ও ফলপ্রসূ করা যায়, তবে সে তার শিক্ষাজীবনের বাকি পর্যায়গুলোয় অত্যন্ত ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারবে। তাই বাংলাদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যায় প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করাসহ সেগুলোয় তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। শুধু প্রাথমিক নয়, মাধ্যমিক শিক্ষায়ও দরকার কিছু সংযোজন। যেমন বর্তমানে বাংলাদেশে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা মাত্র ৬৬২টি। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাকে ছুঁতে পারছে না। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা উচিত। এবার আসি উচ্চশিক্ষার দিকে, উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীদের প্রচলিত জ্ঞানের বিকাশ সাধন করা এবং শিক্ষার্থীর গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত করা। এই গবেষণার যথাযথ ক্ষেত্র মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিশ্চিত করা হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এর যথাযথ প্রয়োগ এখনও লক্ষ করা যায় না। আমরা পূর্ববর্তী পরিসংখ্যানগুলোয় দেখতে পাই, প্রত্যেক বছর প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মোট সিট বরাদ্দ রয়েছে এর চার ভাগের এক ভাগ; অর্থাৎ পর্যাপ্ত আসনের অভাবে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী যথাযথ গবেষণাধর্মী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যদিও বর্তমানে সরকার এই সমস্যাগুলো সমাধানে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিদ্যালয়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শিক্ষকদেরও যথাযথ প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে; কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলোকে আরও দ্রুত ও দুর্নীতিমুক্তভাবে বাস্তবায়ন করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং নজরদারি বাড়াতে হবে। এছাড়া যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগদানের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই একদিন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। আর আমরা সবাই জানি, ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।’ আমাদের জাতির এ মেরুদণ্ডও যে যথেষ্ট শক্তিশালীÑএকদিন আমরা বিশ্বকে তা প্রমাণ করে দেব।
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়