বীর সাহাবী: শিক্ষার সঙ্গে জড়িত এমন সব উপকরণের দাম বেড়েছে। কয়েক দফা দাম বেড়ে এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ কিনে পড়াশোনা করাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীর বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা বেশ শঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই বই, খাতা, কলম কেনা কমিয়েছেন। পাশাপাশি পরীক্ষার সময় গাইড বই কিনতেও কষ্ট হচ্ছে অনেকের।
রাজধানীর নীলক্ষেত এবং বাংলাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ, খাতা, পেন্সিল, ব্যবহারিক খাতা, মার্কার, স্কুল ফাইল, অফিস ফাইল, শিশুদের লেখার সেট, ক্যালকুলেটর, সাদা বোর্ড, জ্যামিতি বক্স, টালি খাতা, কলম বক্স, স্কেল, পরীক্ষায় ব্যবহƒত ক্লিপবোর্ড, কালিসহ সব পণ্যের দাম বেড়েছে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এমন সময়ে শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে হাঁসফাঁস করছেন অভিভাবকরা।
বাংলাবাজার ঘুরে দেখা যায়, আগে ৬৫ গ্রাম কাগজের রিম বিক্রি হতো ১ হাজার ২৮৫ টাকায়। এখন সেই কাগজ কিনতে ব্যয় করতে হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকা। সবচেয়ে বেশি বিক্রীত ৫৫ গ্রাম কাগজ ২০২১ সালে ছিল ১ হাজার ৮৫ টাকা, ২০২৩ সালে এসে তা বেড়ে ২ হাজার ৫০ টাকা হয়েছে। প্রতিটি ছোট খাতার দাম ২০ থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। মাঝারিগুলো ৩০ থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। ১২০ পৃষ্ঠা খাতার দাম বর্তমানে ৪০ টাকা, যা আগে ছিল ৩০ টাকা। ২০০ পৃষ্ঠার দাম ৫০ থেকে বেড়ে ৭৫ টাকা হয়েছে। ৩০০ পৃষ্ঠার দাম ৮৫ টাকা, যা বছরখানেক আগেও ছিল ৬০-৭০ টাকা। অন্যদিকে কলমের দামও বেড়েছে। ৫ টাকার কলমের দাম বেড়েছে ১ টাকা। ১০-১৫ টাকা দামি কলমের দাম ২-৩ টাকা বেড়েছে। পেন্সিলের দামও প্রায় এমনই। কোম্পানিভেদে জ্যামিতি বক্সের দাম ২০-৩০ টাকা করে বেড়েছে। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ স্কেল ও ব্যাগের দামও বেড়েছে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের অতিপ্রয়োজনীয় উপকরণ কলমের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় সব মহলেই এ নিয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আর আগে থেকেই কাগজসহ অন্য জিনিসপত্রের দামও বর্ধিত দামে বিক্রি হচ্ছে। অনেক অভিভাবক এখন সন্তানের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগও জানিয়েছেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলকেন্দ্রিক এলাকায় রয়েছে শিক্ষা উপকরণের স্টেশনারি দোকান, ইউনিফর্ম বিক্রির প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাগ ও জুতার শো রুম। এসব দোকানে ক্রেতারা এসে উচ্চমূল্য দেখে অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বিক্রেতারা বলেন, শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের চিত্র একই। শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কম। কেউ কেউ লাভ কমিয়ে বিক্রি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কয়েকজন ক্রেতা জানান, প্রতিটি শিক্ষা উপকরণেরই দাম বেড়েছে। তাই কেনাকাটায় হিসেবি হতে হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লাইব্রেরি ও স্টেশনারি দোকানে ঘুরে দেখা গেছে, দুই টাকার ফটোকপি এখন চার থেকে পাঁচ টাকা। প্রতি রিম দিস্তা কাগজের দামও বেড়েছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। মোটা মলাটের ২০ টাকার খাতার দাম এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০-৩৫ টাকা। গত ১ জুন বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছিলেন দোকানিরা, যা পরবর্তী সময় তারা কার্যকর করেন। তবে তারা ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত কাগজ আমদানি করতে পারছেন বলে জানিয়েছেন।
বাংলাবাজারের এমদাদিয়া লাইব্রেরির ব্যবস্থাপক রহমত উল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি তারা নাকি ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত পেপার আনতে পারছে না। দেশি যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের সরবরাহকৃত পেপার দিয়েই চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। সবকিছুর দাম বাড়াতে পেপারের দামও বেড়েছে। আগের চেয়ে যাতায়াত ভাড়াও বেড়েছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে আমাদের কেনা বেশি পড়ছে। তাই বাধ্য হয়েই বেশি দামে বিক্রি করা লাগছে।’
জনতা বুক হাউসের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান খান বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেড়েছে। কলম থেকে শুরু করে খাতা, দিস্তা, ক্যালকুলেটর, সাদা বোর্ড, জ্যামিতি বক্স, টালি খাতা যা আছে সবগুলোই আগের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তাই বিক্রি করার ক্ষেত্রেও আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। আগে কেউ ১০টা খাতা কিনলে এখন সে পাঁচটা খাতা কিনছে।’
মতিঝিলে এক অভিভাবক শাহিন আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে পরিবারের অন্য খাতের খরচেও। এতে করে খরচের হিসাব মেলাতে পারছি না। সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তায় আছি। অন্যদিকে বর্তমানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এমনিতেই নাজেহাল। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে আমার মতো অনেক অভিভাবকই রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। আগে যে কলম পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতাম সেটা এখন সাত টাকা। আগে যে খাতা ৩০ টাকায় কিনতাম সেটা এখন ৫০ টাকা। এই বাড়তি খরচের বোঝা বইতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।’
গত বছরের শেষ দিকে বিশ্বব্যাপী ডলারের মূল্য বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে হঠাৎ বেড়ে যায় শিক্ষা উপকরণের দাম। তখন থেকে বই, খাতা, ব্যাগ, পোশাক, সবকিছুরই দাম বাড়তি। বিক্রেতারা বলছেন, আমদানি ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সাংসারিক টানাপোড়েনের মধ্যেই অবশ্য বেশ হিসাব করেই শিক্ষা উপকরণ কিনতে হচ্ছে বলে জানালেন অভিভাবকরা। ক্রেতা ও বিক্রেতাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এবার শিক্ষা উপকরণের জন্য ব্যয় আগের চেয়ে গড়ে অন্তত দেড়গুণ বেশি।
মিরপুরের অভিভাবক আনজুম আরা বলেন, ‘আমার স্বামী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার এলাকার রোজগারে সংসার চালানোর পর সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়াটা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয়। এর মধ্যে কাগজ, কলম, খাতাসহ শিক্ষা উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে দুশ্চিন্তাও অনেকটা বেড়েছে। এখন সংসারের খুঁটিনাটি খরচগুলো কাটছাঁট করে সন্তানদের লেখাপড়া সামনের দিকে চালিয়ে নিতে হবে। আর এটাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে তো সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া আর উপায়ই থাকবে না। তিনি আরও জানান, সরকার যদি এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়, তবে ভবিষ্যতে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে।
অভিভাবক ইমন হাসান বলেন, ‘অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে বছরে কয়েক দফা শিক্ষা উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়ছি। ১২০ পৃষ্ঠার ৩৫ টাকার ভার্সিটি খাতা এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা এবং সন্তানদের হাতের লেখার ২০ টাকার খাতা বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। শুধু কাগজ আর খাতাই নয়, দাম বেড়েছে প্রয়োজনীয় সব শিক্ষা উপকরণের। এভাবে লাগামহীনভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়াতে শিশুদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার আশঙ্কা করছি।’
যোগাযোগ করা হলে সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের কোম্পানি সচিব রাশেদুল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে কাগজ তৈরির কাঁচামালের দাম আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি ডলারের সংকটও একটা অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করেছে। এর সঙ্গে এলসি জটিলতাও ছিল। তবে বর্তমানে এলসি খুলতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। কাঁচামালের দর বৃদ্ধির কারণেই মূলত কাগজের দাম বেড়েছে।’