মেজবাহ হোসেন: শিক্ষা একটি রাষ্ট্রের সনদ, নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের বোঝাপড়া। একটি দেশের শিক্ষাই বলে দেবে; তার ভবিষ্যৎ গন্তব্য কোথায়। শিক্ষা একটি জাতিকে সভ্যতা দেয় আর সভ্যতা থেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা। আফ্রিকার দেশগুলোর কথা যদি চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে শিক্ষা আর সভ্যতার অভাবে হীরা ও স্বর্ণের মতো মহা মূল্যবান সম্পদের খনি থাকা সত্ত্বেও ওরা পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে গরীব আর সমস্যাসংকুল জীবনযাপন করে। অন্যদিকে মধ্য প্রাচ্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি তারা তাদের সমৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য কীভাবে শিক্ষা আর গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়েছে, যাতে ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ ফুরিয়ে গেলেও তারা অন্ধকারে পতিত না হয়। আবার শিক্ষার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মধ্যে আদব, মূল্যবোধ, চিন্তা, দর্শন, বিনয়, আচারণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ইতিহাস, নিয়ম-কানুন সব কিছু শিখিয়ে দেয়। ফলে নাগরিকরা তার রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে সম্যক অবগত থাকে। কেন পশ্চিমের একজন নাগরিক রাস্তায় কোনো ময়লা-বর্জ্য ফেলে না, কেন ট্রাফিক নিয়ম অমান্য করে না বা কেন নিয়মিত উঠানের ঘাস কেটে পরিপাটি করে রাখে আর কেন আমরা সেসব নিয়মের তোয়াক্কা করি নাÑ এর পার্থক্য আমাদের শিক্ষায় নিহিত। ওদের যেভাবে শিখিয়ে বড় করা হয়, আমাদের সেভাবে শেখানো হয় না। আমার দক্ষিণ কোরীয় রিসার্চ সহকারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে কেন ওদের মুখে কখনই দাড়ি-গোঁফ দেখা যায় না, জবাবে সে বলেছিল যে মুখে দাড়ি গোঁফ দেখা যাওয়াটা ওদের কালচারে অসুন্দর আর অসভ্যতার প্রতীক। তাই প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওরা সেভ করে।
কিন্তু আমাদের এগুলো শেখানো হয় না, ফলে আমাদের একটি ক্লাসরুমে বিভিন্ন সাইজের দাড়ি গোঁফওয়ালা ছাত্র চোখে পড়ে (এখানে ধর্মীয় দাড়িকে বোঝানো হয়নি, বরং যারা দাড়ি রাখে না আবার সেভ করে পরিপাটিও হয় না তাদের কথা বলা হয়েছে)। আমাদের মতো কোরীয়দের বড় একটা অংশের প্রধান খাবার হলো ভাত, কিন্তু ওদের কারও আমাদের মতো মেদ ভুঁড়ি দেখা যায় না কেন। আমার এই প্রশ্নের জবাবে সে আবারও একই কথা বলল যে, অসুন্দরকে ওরা অনেক ঘৃণা করে। তাই নিয়মিত শরীর চর্চাসহ সব প্রয়োজনীয় নিয়ম মেনে চলে; যাতে ভুঁড়ি বেড়ে না যায়। এভাবে নিয়ম মেনে চলার কারণে পুরো পৃথিবীতে সব থেকে সুন্দর আর আকর্ষণীয় পুরুষ হলো কোরিয়ানরা। এই যে পুরো জাতিকে একটি সুতোয় গাঁথা সম্ভব হয়েছে শুধু উপযুক্ত শিক্ষার কারণে। তাই শিক্ষায় বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই; তা সে গরিব রাষ্ট্র হোক বা উন্নত রাষ্ট্র।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কিছু বলা যাক। বাংলাদেশে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, স্বনামধন্য একটি স্কুল-কলেজে তিন বছর ও একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর পড়িয়েছি, গত তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি আর আন্ডারগ্রাজুযেটদের পড়াচ্ছিÑ এই ১৩ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে ২০০৯ পূর্ববর্তী বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ নিম্নরূপ: আমাদের মধ্যে ব্যাপক প্রচলিত আছে যে আমাদের শিক্ষার মান নেই।
কথাটা আসলে কতটা সত্য? আমাদের শিক্ষার মানোন্নয়নের অবকাশ আছে সত্যি, কিন্তু মান যে একেবারেই নেই সেটি পুরোপুরি সত্য নয়। মোট জাতীয় উৎপাদনের কমবেশি ২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে আসলে কতটা উন্নত শিক্ষা পাওয়া বা দেয়া সম্ভব, তার ওপর এত ছোট আর কেবল উদীয়মান অর্থনীতি। শিক্ষার মান মূলত কয়েকটি মানদণ্ডের ওপর নির্ভর করে, যেমনÑ শিক্ষকের মান, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, গবেষণা আর গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থানের ওপর। প্রথমে আসি শিক্ষকের মান আলোচনায়। একটি দেশে যখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর থেকে একজন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক (আধা সরকারি) স্কুলশিক্ষকের বেতন, আয় ও জীবনমান নিম্নতর হয় তখন সেখানে কারা এই দুটি পর্যায়ে শিক্ষকতায় আসে আর যারা আসে তাদের শিক্ষার মানই বা কতটুকু? স্বাধীনতার পরপরই হয়তো শিক্ষায় সেভাবে মনোযোগী হবার সুযোগ ছিল না, তখনকার বাস্তবতায় সেটি গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী যত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষায় নজর দেয়ার প্রয়োজন ছিল তা দেয়া হয়নি। ফলে এই এইচএসসি পাস প্রাথমিক শিক্ষক (যদিও অল্প কিছুদিন আগে সেটি ডিগ্রি পাস করা হয়েছে) আর তৃতীয় শ্রেণিতে ডিগ্রি পাস মাধ্যমিক শিক্ষক দিয়ে শিক্ষাকে যতদূর টেনে নেয়া সম্ভব ছিল সেটিই হয়েছে। আধা সরকারি উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজ শিক্ষকদেরও একই অবস্থা। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কথা বললে এটিই সম্ভবত সব থেকে কম সুযোগ-সুবিধা আর জৌলুসপূর্ণ দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি। বিসিএস বা ক্যাডার সার্ভিসে শিক্ষা ক্যাডারের দশাও একই, বঞ্চিত ক্যাডারের তালিকায় ওপরের দিকে, কেবল নামেই ক্যাডার। এত এত অনিয়ম আর অবিবেচনা প্রসূত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শিক্ষার যতটা দৈন্যদশা হওয়ার কথা আমরা তার থেকে ভালো অবস্থানে আছি। বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তুলনামূলক কিছুটা ভালো বেতন (পদোন্নতির মাধ্যমে প্রাপ্য, বেতন স্কেলে নয়), সামাজিক মর্যাদা আর কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কারণে আজকেও মেধাবীদের সেখানে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া যায়, যদিও এই বেতন বা সুবিধা তাদের যোগ্যতা ও সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এর ফলে আমাদের উচ্চশিক্ষার সঙ্গে বিশ্বের উচ্চশিক্ষার একটি সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সামান্য কিছু বর্ধিত সুবিধা আর সম্মান দেয়ার ফলে যদি আমাদের উচ্চশিক্ষা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছুটা হলেও জায়গা করে নিতে পারে তাহলে অন্যান্য স্তরেও সেটি অসম্ভব নয়, আর এখানেই শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার মান নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। আন্তর্জাতিকভাবে এই অনুপাতের স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য মান ১:২০ হলেও আমাদের সেই মান ১:৪০ এরও অনেক বেশি। গবেষণার প্রসঙ্গে আসিÑ আচ্ছা গবেষণা নেই বলে যে আমাদের শিক্ষার মান নেই এমন কথার সত্যতা কতটুকু? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে আমাদের বুঝতে হবে যে গবেষণা কি। যেসব উন্নত রাষ্ট্র যেমন ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, জার্মানি বা দক্ষিণ কোরিয়া যারা অনেক আগে থেকেই গবেষণায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে এবং তাদের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ কেবল তাদের পক্ষেই উদ্বৃত্ত অর্থ বা সঞ্চয়কে গবেষণা ও সামরিক খাতে বিনিয়োগ করা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্র যেখানে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ সেখানে গবেষণাধর্মী একটি উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা কেবলই বোকামি ও অপরিণাম দর্শী।
উন্নত দেশগুলোতে একজন পিএইচডি ছাত্রকে টিউশন ফি মওকুফ করার পরে কেবল মাসিক বৃত্তি দেয়া হয় প্রায় ২ লাখ টাকা, বছরে ২৪ লাখ আর ৫ বছরে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নগদ টাকা; এত খরচের পরে হয় একটি পিএইচডি ডিগ্রি আর গড়ে দুটি গবেষণা পত্র। এভাবে হাজার হাজার ছাত্র এবং বছরের পর বছর ওদের খরচ হয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এবার ভেবে দেখুনতো তো আমাদের পক্ষে কি এত টাকা খরচ করে গবেষণা করা সম্ভব? গবেষণা কিন্তু মূলত শুরু হয় মাস্টার্স পর্যায় থেকে, স্নাতক পর্যন্ত গবেষণা বলতে তেমন কিছু আমেরিকাতেও বাধ্যতামূলক নয়। এই পর্যায়ে যদি বাংলাদেশ ও আমেরিকার গড় স্নাতকদের তুলনা করি তাহলে আমি বাংলাদেশের স্নাতকদের এগিয়ে রাখব কারণ তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা, প্রবলেম সলভিং ক্ষমতা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা অনেক বেশি (কিন্তু চীন বা জাপানের তুলনায় অনেক কম)। আমার মতে, ২০০৯ পূর্ববর্তী সময়ের বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের তত্ত্বীয় কারিকুলাম পৃথিবীর সমৃদ্ধ কারিকুলামগুলোর একটি, এর স্বপক্ষে যদি বলি তাহলে আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু টিকিয়ে রেখেছে ভারত, চীন, শ্রীলংকার মতো দেশের গ্র্যাজুয়েটরা যাদের শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের মতোই। আমেরিকার এই শিক্ষা ব্যবস্থার মাহাত্ম্য আসলে তার ডলার আর ব্রান্ডিংয়ে নিহিত, কিন্তু আমরা যেহেতু আমাদের শিক্ষার তাৎপর্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি এবং ব্রান্ডিং করতে পারিনি। ফলে আমাদের কাছে মনে হয় গবেষণা যেহেতু নেই তাই আমাদের শিক্ষারও কোনো মান নেইÑ যেটা একেবারে ভুল ধারণা। এই সময় আমরা যদি মৌলিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি গবেষণা নির্ভর একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই তবে সেটা হবে ৩০ বছর বয়সি একজন যুবক যদি পুনরায় এসএসসি পর্যায়ে পড়ালেখা শুরু করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখে তার মতো অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। তবে হ্যাঁ কৃষি বা সামাজিক গবেষণা যেগুলো আমাদের জীবন ঘনিষ্ঠ, যেখানে আমাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে এবং অব্যয়বহুল সেগুলোতে আমরা অবশ্যই গবেষণা চালিয়ে যাব।
শিক্ষার মানের অন্যতম নিয়ামক হলো কর্মসংস্থান। আগেই বলেছি, যুক্তরাষ্ট্রে একজন গড় স্নাতকের চেয়ে বাংলাদেশের একজন গড় স্নাতক অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তার একজন স্নাতকের জন্য যেই মূল্যমানের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পেরেছে (বছরে গড়ে ৩৫ হাজার ডলার, মাসে গড়ে ৩ হাজার ডলার বা ৩ লাখ টাকা) আমরা তার ধারের কাছেও নেই। ফলে যেই ধারণা জš§ নিয়েছে যে আমেরিকাতে স্নাতক সম্পন্ন করলে ওখানে ৩ লাখ টাকা বেতনের চাকরি পাওয়া যায়, তাই ওদের শিক্ষার মান অনেক উন্নত। তাহলে এর মানে যা দাঁড়াল সেটা হলো আপনার শিক্ষা যেমনই হোক যদি তার বিপরীতে একটা শক্তিশালী অর্থনীতি আর কর্মসংস্থানের জোগান থাকে তাহলে আপনার শিক্ষাব্যবস্থাই হবে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বিবেচনা আবশ্যক- এক, উন্নত রাষ্ট্রের মতো শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া সম্ভব না হলেও আমাদের শিক্ষা খাতে কমপক্ষে জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দিতে হবে।
দুই, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পুরো শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। তিন, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করতে হবে যাতে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার জন্য যেমন ন্যূনতম সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ বেঁধে দেয়া হয়েছে ঠিক সেভাবে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতার জন্য ৩ দশমিক ২৫ এবং স্কুল পর্যায়ে ন্যূনতম সিজিপিএ ৩-সহ স্নাতক (সম্মান) পাস বেঁধে দিতে হবে, কোন দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণি শিক্ষকতায় গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয় : এক, দলীয় লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, তবে শিক্ষকমণ্ডলী কলাম লেখা, সভা সমিতি বা টকশোর মাধ্যমে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা ও পরামর্শ প্রদান করতে পারবে। দুই, কেবল মাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে, যেমন- পিএইচডি, পোস্টডক, অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা, পুস্তক রচনা, এমএস/এমফিল/পিএইচডি গবেষণার তত্ত্বাবধান সংখ্যা প্রভৃতি।
১৯৭৩ এর অধ্যাদেশে চলা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ চলুক, তবে বাকিদের ক্ষেত্রে দরখাস্ত আহ্বান করতে হবে। ইউজিসির মাধ্যমে আগ্রহীদের মধ্য থেকে হাই ডিসটিঙ্কশনধারী তিনজনের তালিকা রাষ্ট্রপতির দপ্তরে গেলে রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতা বলে তাদের মধ্য থেকে একজনকে নিয়োগ করবেন। তিন, প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুই ঘণ্টার বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা হওয়া আবশ্যক, এর পরে মৌখিক পরীক্ষা ও সামগ্রিক ফলাফলের নিরিখে চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া। চার, ফ্যাসিবাদী সরকার ও এর আমলাতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া নিবর্তনমূলক অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা বাতিল করে শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা করতে হবে। পাঁচ, নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন সংশোধন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আমলাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করে কাজের ও চিন্তার মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ছয়, নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক না থাকায় সেখানে একাডেমিক কাউন্সিল ও রিজেন্ট বোর্ডগুলোতে আগামী ১০ বছর সহকারী অধ্যাপক পর্যায় থেকে প্রতিনিধি রাখতে হবে; মনে রাখতে হবে চাকরি হারানো, মামলা ও সরকারি রোষানলে পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও প্রভাষক এবং সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষকরা অন্যদের তুলনায় ছাত্র-জনতার বিপ্লবে অনেক বেশি সক্রিয় ছিল এবং প্রকাশ্যে ছাত্র জনতার সঙ্গে মাঠে নেমে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিল।
সাত, ডাইনিং হলোগুলোতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ছাত্রদের খাবার মান ও যথাযথ পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে হবে। আট, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের খরচ যেহেতু রাষ্ট্র বহন করে তাই শিক্ষা সমাপনী পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রাষ্ট্রকে তার চাহিদা জানাতে হবে, যেমনÑ বিভিন্ন বিভাগ বা অনুষদ থেকে রাষ্ট্র কি কি উপায়ে উপকৃত ও সমৃদ্ধ হতে পারে তার একটি খসড়া থাকা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু মৌলিক বিষয়গুলো পড়ানো হয় তাই এই বিশাল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েটদের আমাদের সব স্তরের শিক্ষা খাতে নিয়োগ করে শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা সম্ভব। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যেমন রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সংযোগ স্থাপিত হবে তেমনি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য বিশাল একটি কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে।
কলেজ : এক, কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিসিএস প্রথা থেকে বের হয়ে আসতে হবে কারণ বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার তেমন কোনো মিল নেই। ফলে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একজন শিক্ষককে যে যে মানদণ্ডের নির্বাচন করা প্রয়োজন সেগুলো যাচাই করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে একটি শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন করতে হবে যারা উপযুক্ত মানদণ্ডের নিরিখে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে সক্ষম হবে। দুই, ডিগ্রি পাস কোর্সকে বিলুপ্ত করে ওই শিক্ষার্থী শ্রেণির জন্য ভোকেশনাল বা কর্মমুখী শিক্ষা চালু করে তাদের উৎপাদন অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে, এক্ষেত্রে চীনা নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে।
তিন, শিক্ষা প্রশাসনে শিক্ষকদের পদায়নের ব্যবস্থা করতে হবে, প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেষণে অধ্যাপকদের নিয়োগ করা যেতে পারে। মাধ্যমিক স্কুল: এক, মাধ্যমিক পর্যায়েও বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের নিয়োগের বিধি চালু করতে হবে এবং ওই শিক্ষক নিয়োগ কমিশনের মাধ্যমে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। দুই, মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে হবে।
প্রাইমারি স্কুল: শিক্ষার এই প্রাথমিক স্তরে আমাদের সব থেকে বেশি বাজেট বাড়াতে হবে কারণ এই ধাপেই একজন শিশু সব মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে, তাই এই ধাপে আমাদের বিশেষভাবে মনযোগী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এক, এই ধাপে আমাদের বিজ্ঞান সম্মত সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে, যেমন- কার্টুন ও অ্যানিমেশনের মাধ্যমে তাদের শেখাতে হবে কারণ ওইসব কাল্পনিক চরিত্রগুলো শিশুদের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে, শিশুরা আপন মনে ওই চরিত্রগুলোকে তার মনে ও মস্তিষ্কে ধারন করে (যেমনÑ মীনা কার্টুন আমাদের সমাজে অনেক বড় একটা পরিবর্তন আনতে সফল ভূমিকা রেখেছে)। পারিবারিক ও সামাজিক আচারণ, রীতিনীতি, মূল্যবোধের পাশাপাশি পানি ও বিদ্যুতের অপচয় রোধ, নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা-বর্জ্য ফেলা, ট্রাফিক নিয়ম মেনে চলা, ঘুষ ও দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব এবং সবশেষে দেশপ্রেম আর দেশের স্বার্থই সবার ওপরে এমন ভাবনাগুলোকে শিশুতোষ কার্টুন ও অ্যানিমেশন চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। দুই, স্কুলগুলোকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে সাজাতে হবে। তিন, শিশুদের পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্কুলে মিড ডে মিল চালু করতে হবে। এই মিড ডে মিল সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা যাতে এর মধ্য দিয়ে শিশুদের মধ্যে একটি সামাজিক সাদৃশ্য ও মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। চার, কোনোভাবেই স্নাতক পাশের নিচে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে না, নিয়োগের পরে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার আদলে শিশুদের আচারণ, মনস্তত্ত্ব, ও শিশু শিখন পদ্ধতির ওপরে শিক্ষকদের প্রাইমারি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক করা।
এই ডিপ্লোমা প্রোগ্রামে কঠিন কিছু থাকবে না, তবে শিক্ষকদের অবশ্যই মৌলিক কিছু বিষয়ে জানতে হবে। এর জন্য শিক্ষকদের কোনো ছুটি বা ক্লাস করার দরকার হবে না, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট সিলেবাসের বই থাকবে। শিক্ষকরা সেসব বই নিজে নিজে পড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করবেন।
এই সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব মনে হলেও এগুলো নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে, অন্যথায় আমাদের সামনে আগানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। আপনি যখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা জার্মানির মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকদের দিকে তাকাবেন তখন ওদের মধ্যে আচারণ, চিন্তা, জীবনযাপন পদ্ধতি ও দর্শনগত বিষয়ে এক সুস্পষ্ট মিল দেখতে পাবেন। ওরা সবাই যে উচ্চশিক্ষিত সেরকম নয়, আমাদের মতো ওরাও শ্রমিকের কাজ করে, বাস-ট্রাক চালায়, কল-কারখানায় শ্রম দেয়; কিন্তু যেই অদৃশ্য শক্তির কারণে ওরা এত বেশি ঐক্যবদ্ধ ও সদৃশ্যতার বীজ বপন করা আছে ওদের প্রাথমিক শিক্ষায়।