শিক্ষিত বেকারদের জনসম্পদে পরিণত করতে উদ্যোগ বাড়াতে হবে

মো. রায়হান আলী: আজকের শিশুরাই যেমন আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তেমনি আজকের শিক্ষিত মেধাবীরাই আগামী দিনের দেশের নেতৃত্ব দেবে। সঠিক মেধার মূল্যায়ন সঠিকভাবে করে শিক্ষিতদের সম্মানিত করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করাই হলো রাষ্ট্রের কাজ। কিন্তু দিন দিন যেমন শিক্ষার হার বাড়ছে, তেমনি সঠিক কর্মসংস্থানের অভাবে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। শিক্ষার হার যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে কর্মক্ষেত্র বাড়ছে না। চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে শিক্ষিত বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে পাসের হার বাড়লেও আত্মকর্মসংস্থান ও বেকারত্ব দূরীকরণের কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুভা গল্পে বাক-প্রতিবন্ধী সুভাকে তার মা গর্ভের কলঙ্ক বলেছেন। বেকাররা কি শিক্ষার কলঙ্ক!

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ২০১৭ সালে এক বছরে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় এক লাখ বেড়ে গেছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক বছরেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। আর শতকরা হারে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব রয়েছে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে। প্রাথমিক শিক্ষা আছে, এমন লোকদের মধ্যে বেকারত্বের হার দুই দশমিক সাত শতাংশ, কিন্তু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন এমন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১১ দশমিক দুই শতাংশ। অর্থাৎ যিনি যত বেশি শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তার বেকার হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

এমন নয় যে, দেশে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বশেষ জনশক্তি জরিপের তথ্য অনুসারে গত অর্থবছরে ১৩ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেকারের সংখ্যা প্রায় এক লাখ বেড়ে গেছে। যাদের কর্মসংস্থান হয়েছে, তাদের মধ্যে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিতদের সংখ্যাই বেশি। উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের দেশে যে পরিমাণে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি হচ্ছে, তাকে কাজে লাগানোর উপযোগী পর্যাপ্ত ক্ষেত্র নেই।

এটাও সত্য যে, দেশে বেকার ও শিক্ষিত বেকার দূরীকরণের নানামুখী পদক্ষেপে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। শিক্ষিত বেকারদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করা সরকারের আরও পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন। একজন অভিভাবকের প্রধান লক্ষ্য থাকে সন্তানকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরিতে সহায়তা করা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো গত বছর করোনার সময় থেকে কত যে শিক্ষিত ও মেধাবী ছেলে-মেয়েদের চাকরির নির্ধারিত বয়স চলে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই।

করোনায় স্বাভাবিক অফিস-আদালতগুলোর কাজ স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের চাকরিপ্রার্থীরা পড়েছেন আরও বিপাকে। কারণ নিয়োগ পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরি প্রার্থীরা বয়স হারিয়েছেন। তথ্যমতে, এই করোনার সময় কমপক্ষে দুই লাখ চাকরি প্রার্থী তাদের চাকরির বয়স হারিয়েছেন। দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি আজকের নয়, অনেক দিনের। করোনায় চাকরি প্রার্থীরা বয়স হারানোর ফলে সেটা আরও জোরালো হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ সাধারণ বয়সসীমা ৩০ বছর। মুক্তিযোদ্ধা, চিকিৎসক আর বিশেষ কোটার ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা ৩২ বছর। সরকারি ছাড়াও আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও একই বয়সসীমা অনুসরণ করা হয়। আর চাকরি থেকে অবসরের সাধারণ বয়সসীমা ৫৯ বছর। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে তা ৬০ বছর। বিচারকদের ক্ষেত্রে ৬২ বছরের নির্দেশ আছে আদালতের। তবে তা কার্যকর হয়নি। বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের দেশ। জনসংখ্যার ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী শতকরা ৬৮ ভাগ, যারা কর্মক্ষম। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। তবে নারীদের গড় আয়ু ৭৫ বছর। পুরুষের ৭১ বছর। সরকারি চাকরিতে পদ খালি আছে তিন লাখ ১৩ হাজার ৮৪৮টি। সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছেন ১২ লাখ ১৭ হাজার ৬২ জন। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখের মতো নাগরিক চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। সরকারি নয়, এখন বেসরকারি খাতই হচ্ছে চাকরির বড় ক্ষেত্র।

বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক চার শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। এদিকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া প্রতি তিনজনের একজনই বেকার, আর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জিপিএ-৫ যারা পেয়েছেন তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশের বেশি বেকার।

সাধারণভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর যে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। চার লাখ বেকার থাকেন। আর এই বেকারদের অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত। এরকম বেকার কয়েকজন উচ্চশিক্ষিতের কথা হলোÑচাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে তাদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আর গড় আয়ু যেহেতু বাড়বে, তাই প্রবেশের সময়সীমাও বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে এই করোনাকালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো খুব জরুরি। মেধাবী চাকরি প্রার্থীরা করোনার প্যান্ডামিক পরিস্থিতির কারণে জীবনের স্বপ্ন থেকে ছিটকে যাবেন, তা হতে পারে না। সঠিক মেধাকে কাজে লাগিয়ে তা সম্পদে পরিণত করতে হবে।

কোনো শিক্ষার্থীর লেখাপড়া শেষ করতে ২৭-২৮ বছরও বয়স হয়ে যায়। চাকরির প্রতিযোগিতার মাঠে সামান্য কয়েক বছর হাতে থাকে তা যথেষ্ট নয়। এমন পরিস্থিতিতে যদি করোনাকালীন অবস্থা বিবেচনায় নিয়োগ পরীক্ষা না হওয়ায় চাকরি প্রার্থীদের অকালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে যায়, তাহলে সেটা নির্ঘাত কষ্টদায়ক হবে। তাই উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে সার্বিক দিক বিবেচনা করে চাকরি প্রত্যাশীদের অকালে ঝরে গিয়ে যেন বেকারত্বের ঘানি বয়ে বেড়াতে না হয়, সেদিকে সরকারের সুদৃষ্টি এখন সময়ের দাবি। আরও বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষিত বেকারদের মেধাকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের মাধ্যমে তাদের জনসম্পদে পরিণত করে দেশের উন্নয়নের অংশিদারিত্বের ভাগীদার বানিয়ে সোনার বাংলা গড়ার সুযোগ দিতে হবে।

আইনজীবী

জজ কোর্ট, খুলনা

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০