শিল্পাঞ্চলে স্থিতিশীল পরিবেশ ও নীতি সংস্কার চায় ডিসিসিআই

নিজস্ব প্রতিবেদক: শিল্পাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিবেশের উন্নয়ন ও সুদের হার হ্রাস করার ওপর জোর দিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই)। একইসঙ্গে নীতিমালার সংস্কার জরুরি বলেও মত দেয়া হয়েছে। গতকাল ডিসিসিআই মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ পথনির্দেশনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলেচনায় এসব মতামত দেয়া হয়েছে।
সেমিনারে ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, দেশের ভালো ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ পাচ্ছেন না, সেই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা শিল্পখাতে পণ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে, ফলে স্থানীয় চাহিদার জোগান মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি সমন্বিত রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা চেম্বার সভাপতি শিল্পাঞ্চলগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ প্রদানের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। এছাড়াও শিল্পাঞ্চলগুলো বিশেষ করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা স্বল্পমূল্যে নিশ্চিতকরণে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবি জানান।
এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ১৫ শতাংশ বেশি ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে পৃথিবীতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার, তবে আমাদের উদ্যোক্তাদের সেটা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কাস্টমস হাউসগুলো দূনীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যেটি নিরসনে সরকার ফিন্যান্সিয়াল রিফর্মস কমিটি গঠন করার পাশাপাশি অটোমেশন নিশ্চিত করা জরুরি বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, দেশে মধ্যম আয়ের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যাদের করজালের আওতায় নিয়ে আসা গেলে জিডিপিতে রাজস্বের অবদান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং লাভবান হবে আমাদের অর্থনীতি। তিনি আরও বলেন, উচ্চমূল্য প্রদান করেও আমাদের শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, তাই আমাদের অনশোর-অফশোর গ্যাস অনুসন্ধানে আরও জোরারোপ করতে হবে।

লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, আমরা উদ্যোক্তারা এ দেশে থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরও সুদৃঢ় করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, দক্ষ ও ভালো নিয়োগের মাধ্যমে সংকট উত্তরণ সম্ভব, যেটি বাংলাদেশে ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে অনিশ্চিয়তা ও নিরাপত্তাহীনতরা মধ্যে রয়েছে, যা উত্তরণে শিল্পাঞ্চলে বিশেষ করে শিল্পপুলিশ ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে, পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও প্রশাসনের অনেক জায়গা থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, এক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকরের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা প্রদান করা আবশ্যক। তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্থানীয়ভাবে আমাদের চাহিদা কমে গেছে, যেটা উদ্বেগের বিষয়, সেখানে সবাইকে নজর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ডাবল ডিজিটের সুদ দিয়ে ব্যবসায় মুনাফা করা অসম্ভব, তাই আমাদের দীর্ঘমেয়াদি টেকসই অর্থায়ন রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ওপর অধিক হারে জোরারোপ করতে হবে। শুধুমাত্র রেমিট্যান্স ও দাতাদের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের ওপর আরও অধিক হারে গুরুত্ব দিতে হবে।

বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষে কার্যক্রমে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে এবং এ অবস্থা উত্তরণে শ্রমিক-মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যকার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে হবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বেশকিছু দাবি মেনে নেয়া হয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের যেকোনো যৌক্তিক দাবি বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ ইতিবাচকভাবে মেটাতে বদ্ধপরিকর। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক ব্রান্ডগুলো ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্যের যৌক্তিক মূল প্রাপ্তির ওপর তিনি জোরারোপ করেন, যার মাধ্যমে শ্রমিক স্বার্থ আরও সুসংহত করা সম্ভব হবে। এ মুহূর্তে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কনফিডেন্স বাড়ানোর ওপর আরও অধিক হারে গুরুত্ব দিচ্ছি। খেলাপি ঋণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের অধিকাংশ উদ্যোক্তাদের খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন, সেই সঙ্গে শিল্পখাতে গ্যাস সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন করার ওপর জোরারোপ করেন।

ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বিচার বিভাগ, এনবিআর এবং বাংলাদেশে ব্যাংকে কার্যক্রমে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়। তবে বর্তমান সময়ে তৈরি পোশাক খাতের ঝুুট ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প-কারখানায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়, যেকোনো মূল্যে এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ইমেজ সংকটে পড়তে পাড়ে। এছাড়াও তিনি কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রেখে রপ্তানি সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের ওপর জোরারোপ করেন। শামস মাহমুদ আরও বলেন, এলডিসি উত্তরণে আমরা এখনও প্রস্তুত নই, বিষয়টি নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে আমরা গত দুই বছরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার প্রভাব বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীদের আস্থার পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ করে শিল্পখাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মাঠপর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যেটি মোটেই কাম্য নয়, সরকারকে এ বিষয়টিতে নজর দেয়া জরুরি। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, এসএমই খাতে অর্থায়ন ও উন্নয়ন কার্যকর নীতি সহায়তা প্রদান একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, ঋণপত্র খোলাসহ আর্থিক খাতের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে রিজার্ভে আরো ৬ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের সংযোজন ঘটাতে হবে, সরকারকে এ ব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক, সেই সঙ্গে ফরেন এক্সচেঞ্জ ও ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সুসংহত করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আরও ভয়াবহ হবে, তাই সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার ওপর আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ, জ্বালানি স্বল্পতা, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চহারসহ নানাবিধ সমস্যায় আমাদের বেসরকারি খাতে মোকাবিলা করছে, যা দ্রুততম সময়ে উন্নতি করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের শিল্প খাতের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাবে। আহসান খান আরও বলেন, বিদ্যমান উচ্চ ঋণের সুদের হার দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা খুবই কঠিন এবং সুদের হার হ্রাসকরণে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এছাড়াও ঋণ খেলাপির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ওপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, পরিবেশকে সুরক্ষা করেই আমারা প্লাস্টিক খাতকে এগিয়ে নিতে চাই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০