শিল্পায়নের ক্ষতিকর প্রভাব মানবজীবনের জন্য হুমকি

সাকিবুল ইসলাম:প্রাকৃতিক পরিবেশ অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠ, প্রাকৃতিক সম্পদ, ভূমি ও পানি, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, নদী, আবহাওয়া ও জলবায়ুর সমষ্টিকে ভৌগোলিক পরিবেশ বলে। শিল্পায়নের নেতিবাচক প্রভাব প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক আচরণে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। শিল্পীয় প্রতিক্রিয়ায় অর্থাৎ বড় বড় শিল্পকারখানা, রাসায়নিক কারখানা, তেল শোধনাগার, অপরিষ্কার ধাতু গলানো, রাবার ও কটন প্রস্তুত করা প্রভৃতি পরিবেশ দূষণে প্রভাব বিস্তার করছে। বিদ্যুৎশক্তি কেন্দ্র, যানবাহনশিল্প ও কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্যরে প্রভাবে পরিবেশ দূষণ-সহ মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

বায়ুমণ্ডলের শুদ্ধতা মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বায়ু ছাড়া মানবজীবন কল্পনা করা যায় না। ফুসফুস ও শ্বসনতন্ত্রের সঙ্গে বায়ু সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন সাত হাজার ৫০০ লিটার বায়ু প্রশ্বাস হিসেবে নিয়ে থাকে। বায়ুমণ্ডলের প্রধান গ্যাসীয় উপাদান জলকণিকা, যা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে অবস্থান করে এবং বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্ত শিল্প ও তাপীয় শক্তি এবং সার কারখানা ও অ্যালুমিনিয়াম শিল্প থেকে উদ্ভূত হাইড্রোজেন সালফাইড ও হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করে মানবজীবনে নানা ধরনের বিপত্তির সৃষ্টি করছে। যানবাহনশিল্প এবং গৃহকাজের জ্বালানি দহন থেকে সৃষ্ট সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও হাইড্রোকার্বন বায়ুদূষণ করে মানবীয় বিকাশ ও আচরণ প্রভাবিত করছে এবং বিভিন্ন অসুস্থতাসহ মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে শহরসৃষ্ট দূষিত উপাদান মিলিত অবস্থায় নগরীর বায়ুমণ্ডলকে ক্রমেই ব্যবহার-অনুপযোগী করে তুলছে।

শতকরা ৫০ ভাগ হাইড্রোকার্বন ও নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং শতকরা ৯০ ভাগ কার্বন মনোক্সাইড যানবাহন জ্বালানি থেকে নির্গত হয়ে নগরীর বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট আর্সেনিক, সিসা, কপার, নিকেল ও ক্যাডমিয়াম নগরীর বাতাসকে ক্রমেই ভারী করে তুলছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত বিশ্বে মটরগাড়ি থেকে ৪৫ শতাংশ ও বিদ্যুৎশক্তি কেন্দ্রের কয়লা, পেট্রোল ও ডিজেল জ্বালানি থেকে মোট সালফার ডাই-অক্সাইডের তিন ভাগের দুই ভাগ বায়ুতে আসে। আবর্জনা পোড়ানো চুল্লি থেকেও প্রায় পাঁচ শতাংশ দূষণ বায়ুতে মিশে। কীটপতঙ্গনাশক পদার্থ, পেট্রোলিয়াম শোধনাগার, লৌহ ও ইস্পাতশিল্প ও অধাতব খনিজ পদার্থ ক্রমেই বায়ুদূষণ ঘটাচ্ছে। আর্সেনিকযুক্ত আগাছানাশক, কীটনাশক এবং আর্সেনিকযুক্ত ধাতু আকরিকের দহন থেকে বায়ু ও পানিতে আর্সেনিক দূষণের সৃষ্টি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট আর্সেনিক দূষণের ৬৫ ভাগ আসে আর্সেনিকযুক্ত ধাতু আকরিক দহন থেকে। এছাড়া তড়িৎ কেন্দ্র এবং কয়লার দহন থেকে আর্সেনিক বাতাস ও পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। আর্সেনিক বিষাক্ততার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে মারাত্মক বমি, ডায়রিয়া, অস্বাভাবিক হƒৎস্পন্দন, ক্ষুধামান্দ্যসহ শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়ায় চামড়া ও হাত-পায়ের তালুতে কালো দাগ, চামড়া শক্ত ও কালো হয়ে যাওয়া, যকৃৎ, বৃক্ক ও প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, চোখের প্রদাহ এবং সবশেষে ক্যানসার রোগের সৃষ্টি হয়।

শিল্পায়নের ক্ষতিকর প্রভাবে স্ট্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত (গ্রিনহাউস ইফেকট) হচ্ছে, যা মানবজাতি ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ওজোন স্তর সূর্য থেকে আগত অদৃশ্য অতিবেগুনি রশ্মির প্রায় ৯৯ শতাংশ শোষণ করে পরিশুদ্ধ সূর্যের আলো পৃথিবীতে ছাড়ে। কিন্তু কলকারখানার রাসায়নিক প্রভাব  ওজোন স্তরের ঘনত্বের হ্রাস, ছিদ্র বা বিনষ্ট হওয়ায় অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে মানবজীবন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে চোখে ভাঁজ পড়া, চোখধাঁধানো রোগ ও চোখে ছানি পড়া রোগ হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ওজোন গ্যাস নিজেই বিষাক্ত, রাসায়নিক প্রভাবে ওজোন স্তর বিনষ্ট হলে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভূসংলগ্ন অক্সিজেন বিষাক্ত ওজোনে পরিণত হয়। অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হয়। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে বংশগতির বাহক ডিএনএ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে বংশগতির চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে। বায়ুদূষণের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে কার্বো-মনোক্সাইড মানবজাতির জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। এই দূষণ মানুষের শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধনে সক্ষম। কার্বো-মনোক্সাইড রক্তের বিশেষ উপাদান হিমোগ্লোবিন নষ্ট করে দেয়। ফলে মাথা ধরা, মাথা ঝিমঝিম করা ও অবসন্নতার সৃষ্টি হয়। গর্ভবতী মায়ের রক্তে কার্বো-মনোক্সাইড থাকলে গর্ভপাত হয়ে যায়, কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুর জš§ হয়। এছাড়া হাঁপানি রোগ হয়। রক্ত চলাচলে বিঘœ ঘটে, ফুসফুসে রোগ হয়, এমনকি মানুষের মৃত্যুও ঘটে। গর্ভজাত জটিলতাসহ লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শিল্পায়নের ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রভাব। বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয় কণা বিকিরণে বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়। এ ধরনের বিকিরণ বৃদ্ধি পেলে মানুষের দেহকোষ বিনষ্ট হয়, শ্বেত রক্তকণিকার পরিবর্তন ঘটে, এমনকি মিউটেশন সমস্যা ও ক্রোমোজোম অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হয়। ফলে অস্বাভাবিক সন্তান জš§গ্রহণ করে। শিল্পায়ন-সৃষ্ট মারাত্মক পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশেও ১৯৯৫ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন’ প্রণীত হয়েছে। কিন্তু এই আইনের যথাযথ ব্যবহার এখনও দেখা যায়নি। সঠিক আইনের প্রয়োগ করতে হবে, তা না হলে জনজীবন একসময় বিপন্ন হয়ে পড়বে।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০