Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:22 am

শিল্প খাতের ৫ টাকার গ্যাস এখন ৩০ টাকা

ইসমাইল আলী: দেশে গ্যাসের চাহিদা নিয়মিতই বাড়ছে, যদিও সে অনুপাতে সরবরাহ করা হয় না। বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৩৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ করা হয় ২৭০-২৭৫ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার প্রায় ২২-২৩ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ না হলেও বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম নিয়মিতই বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ২০ মাসে তৃতীয় দফা বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। আর আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ১৪ বছরে দেশে গ্যাসের দাম বেড়েছে সাতবার।

সর্বশেষ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত গ্যাসের দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। তবে এবার সব খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। শিল্প, বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ ও বাণিজ্যিক এ চার খাতে বাড়বে গ্যাসের দাম। যদিও এ দাম বৃদ্ধি শিল্প উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলেই দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা অভিযোগ করছেন, বিভিন্ন সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও কখনোই চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দেয়া হয়নি। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে।

১৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক মাসের মাথায় প্রথম গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সে সময় গড়ে ১১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল গ্যাসের দাম। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে দুই টাকা ৮২ পয়সা। এছাড়া শিল্পে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ টাকা ৮৬ পয়সা। সে সময় ক্যাপটিভে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে চার টাকা ১৮ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে (হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য) ৯ টাকা ৪৭ পয়সা।

এরপর ২০১১ সালে সিএনজির (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম কয়েক দফা বাড়ানো হলেও অন্যান্য খাতে লম্বা সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। যদিও ২০১২ সালে পেট্রোবাংলা সব ধরনের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির আবেদন করে। তবে তা খারিজ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। তবে সেবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়নি। সে সময় শিল্পে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে ছয় টাকা ৭৪ পয়সা, ক্যাপটিভে আট টাকা ৩৬ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১১ টাকা ৩৬ পয়সা।

২০১৭ সালে দুই ধাপে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হয় ফেব্রুয়ারিতে। এর মধ্যে প্রথম ধাপ মার্চে ও দ্বিতীয় ধাপ জুনে কার্যকর হয়। সেবার সব খাতেই গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল দুই ধাপে। তবে এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) উচ্চ আদালতে আপিল করে। কারণ আইন অনুযায়ী সে সময় বছরে একবারের বেশি গ্যাস বা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এখতিয়ার ছিল না বিইআরসির।

ক্যাবের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে জুন থেকে কার্যকর হওয়া গ্যাসের দামের মধ্যে আবাসিকের অংশটি বাতিল করে দেন উচ্চ আদালত। এতে মার্চে সব খাতে গ্যাসের দাম বাড়লেও জুনে আবাসিক বাদ দিয়ে অন্যান্য খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পায়। সে বছরের দাম বৃদ্ধির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, মার্চে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে দুই টাকা ৯৯ পয়সা, শিল্পে সাত টাকা ২৪ পয়সা, ক্যাপটিভে আট টাকা ৯৮ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৪ টাকা ২০ পয়সা।

তিন মাস পর অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে তিন টাকা ১৬ পয়সা, শিল্পে সাত টাকা ৭৬ পয়সা, ক্যাপটিভে ৯ টাকা ৬২ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ১৭ টাকা চার পয়সা। এর চার বছর এক মাস পর ২০২১ সালের জুলাইয়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়। তবে সেবার শিল্প খাতকে তিনটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়Ñবৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ও কুটির। যদিও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে প্রণোদনার পরিবর্তে অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ানো হয়।

২০২১ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে চার টাকা ৪৫ পয়সা, বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে ১০ টাকা ৭০ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ১৭ টাকা চার পয়সা, ক্যাপটিভে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা এবং বাণিজ্যিকে ২৩ টাকা। এর ১১ মাসের মাথায় আবারও গ্যাসের দাম বাড়ে। তবে সে সময় শিল্প খাতে গ্যাসের দামের সø্যাবকে সমন্বয় করা হয়। এতে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে দাম বাড়ানো হলেও ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে কমিয়ে আনা হয়।

এতে ২০২২ সালের জুনে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বেড়ে হয় প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা দুই পয়সা, বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা, মাঝারি শিল্পে ১১ টাকা ৭৮ পয়সা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা, ক্যাপটিভে ১৬ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা। তবে সর্বশেষ ঘোষিত মূল্যহারে শিল্প খাতে গ্যাসের সব ধরনের সø্যাব তুলে দেয়া হয়। এতে ২০১৭ সাল বা আগের সময়ের মতো বৃহৎ, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে গ্যাসের অভিন্ন মূল্যহার করা হয়েছে।

আগামী মাস থেকে কার্যকর হতে যাওয়া দামের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বেড়ে হবে ১৪ টাকা, শিল্পে (সব ধরনের) ৩০ টাকা, ক্যাপটিভে ৩০ টাকা এবং বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। এ হিসাবে আগামী মাস থেকে বাণিজ্যিকে ২৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, ক্যাপটিভে ৮৭ দশমিক ৫০, বৃহৎ শিল্পে ১৫০ দশমিক ৪২, মাঝারি শিল্পে ১৫৪ দশমিক ৬৭, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে ১৭৮ দশমিক ২৯ এবং বিদ্যুৎ খাতে ১৭৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ দাম বাড়তে যাচ্ছে।

দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে বেশি দামে এলএনজি কিনে এসব খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। দাম বৃদ্ধির বর্ধিত আয় দিয়ে মার্চ থেকে এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে দৈনিক গ্যাসের সরবরাহ বাড়তে পারে ২০ কোটি ঘনফুট। এরপরও বিদ্যুৎ ও শিল্পের চাহিদা মেটাতে দিনে ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকবে।

প্রসঙ্গত, গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ২০১৮ সালে আগস্ট থেকে সরকার এলএনজি আমদানি শুরু করে। একসময় দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ হতো আমদানি করা এলএনজি থেকে। কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এবং স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনত সরকার। করোনার সময় এ দাম দু-তিন ডলারে নেমে আসে। তবে করোনা-পরবর্তী চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত বছর আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। দাম বাড়তে থাকায় স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ করে দেয় সরকার। একটা সময় এ দাম ৫৪ ডলার ছাড়িয়ে যায় স্পট মার্কেটে।

যদিও গত কয়েক মাস ধরে তা কমছে। বর্তমানে ২২-২৩ ডলারে এলএনজি (প্রতি এমএমবিটিইউ) বিক্রি হচ্ছে। তবে ডলার সংকটের কারণে কম দামের এ সুযোগ নিতে পারছে না সরকার। এতে গত বছর (২০২২) এলএনজি আমদানি প্রায় ৯৪ শতাংশ কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে সব খাতে। বিদ্যুৎ ও শিল্পে গ্যাসের ঘাটতি চরমে পৌঁছায়। সংকট মোকাবিলায় সরকার ঘোষণা দিয়ে বিদ্যুতে লোডশেডিং শুরু করে। শিল্প মালিকরা গ্যাসের জন্য হাহাকার শুরু করেন। তারা বাড়তি দাম দিয়ে হলেও গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা চান। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয়।

বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ দৈনিক ২১৭-২১৮ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। তবে গত বৃহস্পতিবার সরবরাহ করা হয় মাত্র ৮৫ দশমিক ৬০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ গ্যাস দেয়া হয় বিদ্যুৎ খাতে। আর শিল্প খাতে চাহিদা ১২০ কোটি ঘনফুটের মতো। তবে ৮০ কোটি ঘনফুটের মতো দেয়া হয়। অন্যান্য খাতেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস দিতে পারছে না সরকার।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যবসায়ীদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই সরবরাহ বাড়াতে বিদ্যুৎ ও শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। পরিকল্পনা রয়েছে মাসে বাড়তি দুই কার্গো এলএনজি কেনার। এতে বিদ্যুৎ ও শিল্পে চাহিদামতো গ্যাস দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ প্রসঙ্গে বলেন, কদিন আগে বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হলো। অথচ প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা দরে গ্যাস কেনার মতো সক্ষমতা কোনো শিল্পের নেই। তাই বর্ধিত দাম কমিয়ে ইউনিটপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ টাকা করা উচিত। আর অবশ্যই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দিতে হবে। এর পরও সরকারের সহযোগিতা লাগবে। সোর্স ট্যাক্স এক শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৫ শতাংশ করতে হবে। জুন পর্যন্ত শিল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ স্থগিত রাখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকেই দাম বৃদ্ধি কার্যকর হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে কি সরকার বর্ধিত গ্যাস দিতে পারবে? তাই যখন থেকে সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হবে, তখন থেকে বর্ধিত দাম কার্যকর হওয়া উচিত।